কবিরাজ

 

Kobiraj
কেন যে লোকে তাকে কবিরাজ ডাকে সে নিজেই জানে না। কবিরাজ হওয়ার মত কোন গুণ তার মাঝে নেই। তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবাই জানে কোন চিকিৎসা জ্ঞান নেই লোকটার। জীবনে কোনদিন কাউকে একটা কবচ তাবিজও দেননি তবুও তার নাম কবিরাজ!

ছোট ভাই হোমিও ডাক্তার। তাই বড় ভাই কবিরাজ এমন একটা রিউমার রয়েছে গ্রামে।

গ্রামের মানুষ এক সময় বেঁচে থাকার জন্য  যতটুকু দরকার ততটুকু শস্য উৎপাদন করতো। বন্যা, খরা , প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভাগ বসালে অন্য চিন্তা করতো। নইলে ভাতের ব্যবস্থা থাকলে গল্প গুজবেই কাটতো দিন। এই সময়ের খাই খাই ভাব এত প্রকট ছিল  না পঞ্চাশ বছর আগেও। সেই সময়ের গল্প কবিরাজের।

গ্রামের অনেক মানুষের নাম ছিল ছদ্মনাম। মুখে মুখে রটে যাওয়া নামেই মানুষ চিনতো তাদের।  অবশ্য যার নাম তার সামনে নাম নেওয়ার বিধিনিষেধ ছিল। যেমন সবুজের বাপের নাম বাদুর। হাতগুলো লম্বা ,পাতলা শরীর। উদোম গায়ে গ্রামের এই মাথা হতে ঐ মাথা হাঁটছেন না উড়ছেন, বোঝাই দায়। কখন আসছেন কখন যাচ্ছেন বোঝা দায় তাই তার নাম বাদুর।

প্রণোজিতের বাবার নাম তেলচোরা। খাটো প্রজ্ঞাবান এই মানুষটার নাম কেন তেলাপোকার নামে রাখা হলো তা বোঝা দুষ্কর।

কিডনি নষ্ট হয়েছে এমন খবর বিলাতে গিয়ে বলেছিলেন জগদীশ যেন কাকে বলেছিলেন রামুর ক্লিনিং নষ্ট হয়েছে। সেই থেকে জগদীশের নাম ক্লিনিং। প্রদীপের বাবার নাম ব্রেইন। পাগলাটে স্বভাবের সহজ সরল লোকটা সব সময় উচ্চমার্গের দার্শনিক কথা বলতেন তাই তার নাম ব্রেইন। মাঝে মাঝে মনে হয় এই গ্রাম বাংলাদেশের একটা আদর্শ গ্রাম। কী নেই এ গ্রামে?

কবিরাজ এভাবেই নামটা পেয়েছিলেন হয়তো। তবে কেউ কেউ  বলে জায়গা বিক্রির নেশায় পেয়েছিল কবিরাজকে। বাড়ির পাশে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। আশে পাশের গ্রামের জমির দিকে নজর পড়ল মধ্যবিত্ত মানুষের। তিন চার পাঁচ ডেসিমেল করে বিক্রি হতে থাকল ধানী জমি, ডোবা, টিলা, গোপাট, খিল পতিত সব ধরণের জমি। উন্নয়ন হলে আদিবাসীদের যা হয় তাই হতে থাকল ডালিয়া গ্রামে। জায়গা বেঁচতে বেঁচতে স্বচ্ছল কৃষক মাত্র চার পাঁচ বছরে ভিটে পর্যন্ত বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে গেল, টের পেলো না। আবু ইসহাকের ভাষায়,‘ টের পেলে কি জোঁকে খাইতে পারে?’

কবিরাজের দশাও এরকম হলো। বাড়ির বড় ছেলে। বাটোয়ারানামা ছাড়াই বিক্রি করতে লাগলেন জমি। নিজের জমি শেষ করে হাত দিলেন ভাইদের জমির দিকে। কিছু জমি বিক্রির পর ঝামেলাও হলো। তারপর কেউ কবিরাজের জমি কিনতে গেলে দালালরা সতর্ক করত ক্রেতাকে। ' ভাই, বুঝে শোনে নিজ দায়িত্বে কিনবেন। জমির মালিক কিন্ত অনেক বড় কবিরাজ। বিনা দলিলে অপারেশন (রেজিস্ট্রি)করতে পারেন।

চার্বাক দর্শন এসে ভর করল গোয়ালির হাওরের আশেপাশের লোকজনের ওপর। গোয়ালির হাওরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বানাচ্ছে সরকার। সরকার তিনশ বিশ একর জমি কিনেছে পানির দামে। অনেকে দালাল ফড়িয়ার হাতে টাকা খুঁইয়েছে। জমি গেছে, টাকাও গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম শুরুর আগেই দালালরা তাদের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ পুরোদমে চালু করল টিলারগাও, নাজরগাও, ডালিয়া, চাতল, বাগের বাজার, দুসকি, নালিয়া, বাদাঘাট এমনকি মইয়ারছর পর্যন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় কিছু প্রফেসরও হাত লাগালেন জায়গা কেনা বেচায়।

আগে জমির কিয়ার (ত্রিশ শতক) ছিল ষাট সত্তর হাজার। এই জমি উন্নয়নের ঠেলায় শতক বিক্রি হচ্ছে সত্তর হাজার টাকায়। দালালরা বুঝালো না খেয়ে মরছো, ধান হয় না, পান হয় না, বেচো। বেঁচে থাকলে আবার হবে। আর ভার্সিটি জমি নিয়ে গেলে চুষতে হবে আঙ্গুল।

এই লোভনীয় অফার, বিলাসী জীবনের হাতছানি সবার মত কবিরাজকে ডাকে। জমি বেচার টাকায় প্রথমেই ঠিক করান চোখ। ছানি অপারেশনের পরে  কিনেন দামি ফ্রেমের পুরু চশমা। দোকানদার বুঝায়, যত দামি ফ্রেম লাগান দেখবেন কিন্ত গ্লাসেই। দালাল বুঝায় কবিরাজের চশমা বলে কথা। সাত গ্রামের লোকজন চেয়ে দেখবে, কবিরাজ বাবু যায় চশমাটা দেখো। এই তল্লাটের কেউ এত দামি চশমা কখনো পরেনি।

গ্রামের কিছু মানুষের কাজ কুমুদের দোকানের  সামনের কালভার্টে আড্ডা  মারা। সকাল, বিকাল, রাত সমানতালে আড্ডা।

কবিরাজ যেদিন রিক্সা বোঝাই করে  বাজার করে ফিরেন লালবাজার থেকে মৃত রুই কাতল জীবিত হয়ে মাথা বেরে করে দেখায় গ্রামের মানুষকে। কুমুদের দোকানে না দাঁড়ালেও চলে না কবিরাজের। তিনি জানেন এই স্টেশন থেকেই সকল খবর ডালিয়া গ্রামের পরতে পরতে পৌঁছায়। তার ছেলে মেয়েরা এসব খবর শোনে তাকে আক্রমণ করে। এটা ওটা কেনার বায়না ধরে। ছেলে নিপেশ মোটর সাইকেলের বায়না ধরছে কিছুদিন ধরে।

তবুও কবিরাজ থামবার পাত্র নন। জমি বেচার টাকা ফুরিয়ে গেলে ধার করেন দালালদের কাছ থেকে। চার্বাকদের ছাড়িয়ে গেছেন কবিরাজ ঋণ করে শুধু ঘি খান না , আশি বছর বয়সে নতুন করে  বিয়ের চিন্তাও নাকি করছেন।

কবিরাজের জীবন গল্পের মত হয়ে পড়েছে। গ্রামের সীমা পার হয়ে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে পৌঁছেছে কবিরাজের আয়েশি জীবনের খবর।

ইউনিভার্সিটির পত্তনে সবাইই জায়গা বিক্রি করছে। খাচ্ছে দাচ্ছে কিন্ত কবিরাজকে নিয়ে এত আলোচনা কেন? একটাই কারণ কবিরাজ জমি বেচে রাখডাক করতেন না। কাস্টমারের কাছ থেকে এডভান্স নিয়েই ছুটতেন বাজারের দিকে। আর অন্যরা করতো টালবাহানা। খুব গোপনে করতো বিকি বাট্টা। প্রত্যেকে এমন ভাব দেখাতো যেন এটাই তার শেষ বিক্রি। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে বেচতো না। কিন্ত ঘুরে ফিরে একই অবস্থা। জমি বিক্রি করতে করতে প্রায় সবাই নিঃস্ব হয়েছে।

কবিরাজও একসময় নিঃস্ব হয়েছিলেন। কিন্ত তার থিওরী তাকে আলাদা করেছিল। তিনি ভোগ করে নিঃস্ব হতে ছেয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে তাই তার মনে জমি হারানোর বেদনা ছিল না।

কবিরাজ গল্প হবার মত মহান বা পতিত কোন চরিত্র নয়। তাকে নিয়ে কোন গল্প উপন্যাস রচিত হয়নি। তার নামে বিশাল যাগ-যজ্ঞ হয় না। কিন্ত রাতে দিনে কবিরাজের সচেতন ও অবচেতন মনে আসে এক হাতি। তার উপরে বসা এক অপূর্ব সুন্দর পুরুষ। তাকে মাহুত বলতে ইচ্ছে করে না। রাজপুত্রের মতই মনে হয়। হাতির গায়ে ঝুলছে বাহারি রঙের ঝাঝর। যার উপরে রাজপুত্র বসে আসে। সে তাকে ফুটো হওয়া পয়সা রাখার থলে দেখায়। আজকাল স্বর্ণের দোকানে এসব ব্যাগ ব্যবহার হয়।  কিন্ত রাজপুত্রের ব্যাগ ছিল বেশ বড়। সে বলল কবিরাজ ,তুমি এ  নিয়ে এত ভেবো না । তোমার মাধ্যমেই এ বংশের বিনাশ শুরু হলো। আজ থেকে হাজার বছর আগে এই কাটাটিলায় আমার মোহরের লোভে তোমাদের পূর্ব পুরুষেরা আমার হাতি ও আমাকে পানির সাথে বিষ মিশিয়ে মেরেছিল।

মরার আগে কবিরাজকাকে যেন গল্পটা বলেছিল। গল্পটা ভৈরবতলা আর উপানন্দ ঠাকুরের ভিটায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কবিরাজমরার পরেও গল্পটা কেউ বিশ্বাস করছে না। তাই তার যাওয়া হলো না এ গ্রাম ছেড়ে।

 লেখক: পার্থ প্রতিম নাথ

আরও পড়ুন: কুতুব

https://www.parthiv.info/2023/06/Qutb.html

parthiv

parthiv Means Earth Related. We Want To Learn Life Of Earth.

Post a Comment

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال