জীবনে সময়মত ভিক্ষা চাওয়া এবং পাওয়া বড় কথা। বাল্যে স্নেহ ভিক্ষা। গুরুর কাছে শিক্ষা ভিক্ষা। সেবা, শিক্ষা চিকিৎসা, আশ্রয় এসবই সকলের বেলায় আপনা আপনি হয় না। সিংহভাগ মানব শিশুকে চেয়ে দাবি পূরণ করতে হয়। পাওয়ার জন্য কাঁদতে হয়। এমনকি মাতৃদুগ্ধ পর্যন্ত। এসব ক্রিয়াকর্ম শিশুর ভিক্ষাকার্য। জানি ভিক্ষা শব্দে বাঙালির এলার্জি আছে। ভিক্ষাকে বেগ বললে খারাপ লাগে না। আই বেগ টু।
ভিক্ষা চাইলেই কী পাওয়া যায়? যে পায় সে ভাগ্যবান। যে পায় না সে ভিক্ষুক। আজন্ম ভিক্ষুক। ভিক্ষা অর্জিত হলেই ভিক্ষুক সমাজের নেতা ত্রাতাতে পরিবর্তিত হয়। এ কালচার রাজনীতি শিক্ষা ধর্ম অধর্ম সব জায়গাতেই সমান। আজ যে পা চুমে বিভিন্ন রকমের ভিক্ষা চাইছে। আগামীকাল পরিচয় পরিবর্তনে অনেকেই তার কাছে করুণা ভিক্ষা করবে। ভাই আমার কাজটি ?
আজ সকালে গেটলক বাসে দেখা হল সুমনের সাথে। ছেলেবেলার খেলার সাথী সুমন। সতু বাবুর জেষ্ঠ্য সন্তান।
বাসের সামনের একটি সিটে বসেছে সুমন। আমার সাথে বাসে ওঠার সময় কথা হয়েছে। আরে সুমন তুই!
প্রদীপদা তুমি! দুটি বাক্য যেন দুই নদীর মিলন ঘটাল। দুটোই মরা নদী। প্রত্যেক মানুষের ভেতরে বয়ে চলেছে কত নদী। ঢেউ তরঙ্গ সবই আছে। শুধুই কান পাতার অভাবে টের পায় না অনেকেই। তবুও বৃষ্টির জলের এক ফোঁটা স্পর্শে মরা নদী পূর্ণতার আনন্দে কেমন মাতোয়ারা !
কই যাও,কই থাকো দাদা?
এইতো যাই, ঐ তো থাকি।
তুই কই যাস?
কানাইঘাট যাই। ভিক্ষা করতে। তুমিতো জান আমি পঙ্গু। পোলিও আমার বাঁ পা টি খেয়েছে ছোটবেলায়। বাবা নাই আজ ত্রিশ বছর। আমি প্রতিদিন নতুন নতুন জায়গায় যাই। ভিক্ষা করি। এখন মায়ের সঙ্গে ঘরে আরো তিনটি মুখ। স্ত্রী ও দুটি সন্তান। আমার এছাড়া কোন উপায় নেই।
বাস ছাড়বে। আমি সুমনকে থামালাম।তোর সিটে বস।
নে এটা ধর। ময়লা একটা একশ টাকার নোট তার হাতে দিলাম। বললাম নেমে কথা হবে। সুমন হাত বাড়িয়ে নিল। তার মুখে কীরকম একটা হাসি। সুখ না তাচ্ছিল্য আছে হাসিতে। বুঝতে পারি না। সিটে বসে একটু পরেই আসে তন্দ্রা। আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সতু বাবুর পান ভাণ্ডার।
সুমনও কি একই ছবি দেখছে, কী জানি?
কানাইঘাট বাজারে নেমেছে সুমন। একটু পরে শুরু করবে তার ভিক্ষাভিজান। আজ পঁচিশ বছর ধরে সে করে আসছে সে এ কাজ। হঠাৎই চোখের কাছে ধরা পড়ল অদ্ভূত এক ছবি। আরে এ যে আমাদের দোকান ,সতুবাবুর পান ভাণ্ডার। রেল লাইন নেই, স্টেশন নেই তবুও কীরকম ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তার বাবার পান ভাণ্ডার। তার এক সময়ের সুখের ঠিকানা।
শিরিষ গাছের মরা পাতা ঝরে ছোট্ট পান ভাণ্ডারের চাল ভরে আছে। ঝরা পাতার সুমনের জীবনের মত। গাছ থেকে ঝরে চালে আশ্রয় নেয়। ঈশ্বরের তাও সয় না। দমকা বাতাসে আবার মাটিতে ফেলেন। দুনিয়ার মানুষ পায়ের তলায় পিশে আসে যায়। ঝরা পাতার জীবনের অবসান সহসা কী হয়। কত যন্ত্রণা গঞ্জনা সওয়ার পর ধরণী জননী তার সাথে মেশার সুযোগ দেন। আজ সুমনের খারাপ দিন। নস্টালজিক হয়ে পড়েছে সে। ভেসে ওঠছে একের পর এক ছবি। টিকেট কাউন্টার আর তার বাবার দোকানের ফাঁক দিয়ে অনবরত আসছে যাচ্ছে বিশাল অঞ্চলের মানুষ। ভাটেরা, বরমচাল ,ভূকশিমইল,মুক্তাজিপুর কত কত জায়গার মানুষ। ট্রেন ছাড়া দূরে যাওয়ার কোন গতি নেই এদের। তাই বিরাট এলাকার মানুষ হাজির হয় বরমচাল রেল স্টেশনে। চব্বিশ ঘন্টা সরগরম থাকে রেলস্টেশন। স্টেশনের প্রাণ সতুবাবুর পান ভাণ্ডার ,ইদ্রিস মিয়ার চায়ের দোকান। সতুবাবুর হাতের এক খিলি পান ছাড়া যাত্রীর যাত্রা অপূর্ণ থেকে যেত। কেউ মিস করতে চাইতো না। অনেকেই ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে পড়ত, পান নিয়ে পড়িমরি ওঠে পড়ত ট্রেনে। সতুবাবুর পানের কীরকম মিষ্টি সুভাস ছড়িয়ে পড়েছিল সিলেট থেকে আখাউড়ায়। সতুবাবুর দুধে আলতা চেহারা ক্রেতাকে কম আকৃষ্ট করত না।
কোন শীতের সকালে বাবার হাত ধরে দোকানে আসত সুমন। শীতের কাপড়ে আগাগোড়া মোড়া সুমনকে পুতুলের মত লাগত। পরম মমতায় সতুবাবু ছেলেকে বসিয়ে রাখতেন দোকানে। কত মানুষ খাতির করতো পুতুলের মত সুন্দর শিশুকে। অনেকেই এট ওটা জোর করে খাওয়াতে চাইতো আদরের ঠেলায়। আলতাফ নামের যে লোক টা সতুবাবুর পান ধুয়ে দিত, ফাই ফরমাশ খাটতো,সে কত আদর করত সুমনকে। মাটিতে পা ফেলতে দিতনা সুমনকে। ঈশ্বর তার পা টাই নিয়ে নিলেন !
সুমনের নতুন চোখ অবাক হয়ে দেখত সুন্দর মায়াভরা এ পৃথিবীর সুখ। আজ ছোখ কেন জলে ভরে ওঠেছে। ছোখের চাহনি অস্পষ্ট হয়ে আসছে। তবে কি আজ ভিক্ষা করা হবে না? অতীত সুখস্মৃতি রোমন্থন করলেই কি আজকের পেটের ক্ষুধা ভুলে যাওয়া যাবে !
নিজের পেটের ক্ষুধা জানান দেয় যখন তখন স্মৃতি সুখ দুঃখ গল্প কবিতা গান সবই অসার হয়ে পড়ে। কিন্ত সুমনের আজ কী হল কানাইঘাট থেকে ফেরার চিন্তাই ভূলে গিয়েছে সে। বাজার পেরিয়ে সূরমার পারে বসে সুমন। নদীর চরে সবজির আবাদে চঞ্চল মানুষেরে দেখে মনে পড়ে যায় ছানু ঠাকুরের কথা। শীতের দিনে খটোই(চোট্ট) বিছরায়(জমি) সবজি চাষ। সেই বালক সুমন জানত না তাদের নিজস্ব বাড়ি ছিল না। তারা ছিল ছানু ঠাকুরের বাড়ির আশ্রিত। দুনিয়া ভরা এত জমি। তার নিজের বলে পা রাখার জমি নেই। সুমন এটা জানল সতুবাবুর মৃত্যুর পর।
স্নেহ মায়া মমতা সব উবে গেল সবার। সতুবাবুর মৃত্যুর পর বন্ধ হল পান ভাণ্ডার। সুমনদের হারাতে হল আশ্রয়। বৃক্ষের পতনের পর তার শরীরে বাসা বাঁধা পাখি কীট- পতঙ্গ কী থাকে পারে ? পারে না। থিতু হতে গিয়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সুমনের পরিবারের হল সেই দশা। সতুবাবু নামক মানববৃক্ষ মরে যাওয়ার পর একে একে ভেঙ্গে পড়ল তাকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা বৃত্ত। সুমনের ছোট ভাই সুজন। এত নাদুসনদুস ছিল,যে দেখত গাল টিপে দিত। প্রতিবেশি রানাবাবুর বড় আদরের ছিল সুজন।
বেশি সুন্দর শিশুদের প্রকৃত নামের বাহিরে বহু নাম থাকে। একই শিশুর নাম বাবার কাছে এক, মামার বাড়িতে আরেক। প্রতিবেশিরাও কতজন কত নামে ডাকে। সুজনের তাই নামের অভাব ছিল না। রানাবাবু ডাকতেন বা।' বা' কোন নাম হতে পারে ? কেউ এ নামে আছে কিনা জানি না। কিন্ত বা ডাক শুনলেই পাগলের মত ছুট দিত সুজন। রানাবাবুকে সেও বা বলে ডাকত।
রানাবাবু স্থানীয় হোমিও ডাক্তার। বয়স চল্লিশের ওপরে হলেও বিয়ে করেননি। এই ধরণের পুরুষের মধ্যেই পিতৃত্বের আকাঙ্খা থাকে বেশি। সন্তান না থাকায় এই ধরণের পুরুষ নিজেকে পুরুষ জাহির করার জন্যও অন্যের শিশুর প্রতি কোন কোন ক্ষেত্রেই বেশি ভালোবাসা দেখায়। সুজনের বেলায় তা ঘটেছিল। ব্রাহ্মণ রানাবাবু ভালোলাগার কারণে সুজনকে ছাড়া দুপুরের ভাত খেতেনই না। সুত পুত্র সুজন ব্রাহ্মণ শুদ্রের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছিল। আজ কোথায় সুজন? কোথায় রানাবাবুর ভালোবাসা ?
সুরমার পানি তুলে এক মা দুপুরের রোদে গোসল করাচ্ছেন তার শিশুকে। সুমনের স্মৃতি তাকে নিয়ে যায় আরো গহীনে। সে জানে সবই ভ্রম। তবুও ভাবে ঐ মহিলাই বুঝি তার মা। ছানু ঠাকুরের আমগাছের তলে চৌকির ওপর সুজনকে স্নান করাচ্ছেন। পাতার ফাঁক দিয়ে চুরি করে ঢুকছেন সূর্যদেব। সুন্দর শিশুকে তিনিও দিতে চান গরমের ওম। মা পানি ঢালেন আর সুজন খিলখিল করে হেসে ওঠে। সুমন পাশে দাঁড়িয়ে দেখে আর ভাইয়ের মায়ের সঙ্গে আনন্দ ভোগ করে। আজ যেন তাই ঘটে চলেছে।
মা মা মাগো অস্ফুটো স্মরে ডাকে সুমন। দীর্ঘ সুরমা পাড়ি দিতে পারে না সুমনের ডাক। মায়ের কথা বড়ই মনে পড়ে সুমনের।
সতুবাবুর পান ভাণ্ডারের পান সুপারি আর চুন মিশিয়ে যে টকটকে রঙ,তার মায়ের সিঁথির সিঁদুরের কথা মনে করিয়ে দেয় সুমনকে। তার মা প্রায়শই সিঁথিতে সিঁদুর দেয়ার কথা ভুলে যেতেন। পাড়ার মহিলারা এ জন্য মন্দ কথা বলত। তাদের ধারণা সিঁথির সিঁদুরের মায়া নেই সুমনের মায়ের। এতে সতুবাবুর অমঙ্গল হতে পারে।
সুমনের মায়ের ছিল অদ্ভুত স্বভাব। সবার সাথে কথা বলতেন সমান তালে। মাঝে মাঝেই আবোল তাবোল ও বকতেন। রানাবাবুর মা এইজন্য মাঝে সাঝে বকতেন তার মাকে -ইতা কিতা বেটি। ঘরর বৌ ইভাবে মাতেনি !
সতুবাবুর শতভাগ সুখ ছিল না সুমনের মাকে নিয়ে। লক্ষ্মীমতি নারী বলতে যা বুঝায় তার পুরোটা ছিল না সুমনের মায়ের মাঝে। সতুবাবু বউয়ের ওপর হাত তুলতেন কখনো সখনো। অবশ্য গ্রাম দেশে বউ পেটানো তখন ছিল পুরুষের নিত্যকার অভ্যাস। সুমনের মায়ের উচ্চস্বরের ক্রন্দন আছড়ে পড়ত সরকারী পুকুরের পাড়ে। রাতের বেলায় অনেক রাত করে বাড়ি ফিরতেন সতুবাবু। রাত বারোটার জালালাবাদ ট্রেন বিদায় করে বাড়ি ফিরতে রাত এক টা। আমড়া গাছ হতে টিনের চালে ঝরে পড়ছে পাকা আমড়া। কুয়াশায় আচ্ছন্ন কালৈভরবের তলা। মায়ায় আচ্ছন্ন বাড়ির উঠান। সতুবাবু ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছেন আর কড়া নাড়ছেন দরজার। সুমনের মায়ের সাড়াশব্দ নেই।
সুমনকে দেখে আমি একশ টাকার দায়সারা সাহায্য করলাম, কেন ?
আমি কী চাই সুমন এভাবেই ভিক্ষুক থাকুক।
সমাজের সুবিধাজনক জায়গা যারা দখল করে নেয় তারা কী চায় অন্যরা উঠে না আসুক। প্রতিদ্বন্ধী সৃষ্টি করে নিজের বিপদ ডেকে আনার কোন মানে আছে? তাই দান খয়রাতে আমরা কি দ্বায়িত্ব পালন করি? না নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করি? নিজের রুটির উচ্ছিষ্ট ছুঁড়ে দিই অনাহুতের দিকে।
একটু জেগে দেখে নিই আমি কোথায় আছি। না সব ঠিক আছে। আমি বাসেই আছি। আমার সহযাত্রী ঘুমে অচেতন। নাক ডাকছেন। বিশাল বপু দিয়ে আমাকে চেপে ধরেছেন। বাস দরবস্ত বাজার পর্যন্ত এসেছে। রাস্তা এখনো অর্ধেক বাকী। সহযাত্রীর শরীরের চাপ মেনে নিয়েই আবার চোখ বুজলাম। এভাবে চোখ বুজেই জীবন টা যদি কাটানো যেত!
চোখ বুজার আগে দেখে নিলাম সুমন সামনের সিটে বসে আছে। তার চোখ খোলা। জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে।কী জানি কী আছে তার মনে ? তার কেন ঘুম আসে না? গেটলক বাস । ওঠা নামার ঝামেলা নেই। প্রায় সবাই ঘুমোচ্ছে। সুমনের ঘুম নেই।
পৃথিবীর কোন মানুষ স্বীকার করে না সে সুখে আছে। যদিও কেউ কেউ আত্মস্বীকৃত সুখী। তবে তাদের সুখ সমাজ সন্দেহের চোখে দেখে। সুখের কথা কেন আসল ? হয়তো ঘুমের কারণে। মনে সুখ না থাকলে নাকি ঘুম আসে না। তাহলে সুমনের মনে কী সুখ নেই। ভিক্ষুকের কি সুখের দরকার আছে ? ক্ষুধার অন্ন যোগাতেই তার আনন্দ, এটাই তার সুখ?
দুপুর রোদে আদরের স্নান দৃশ্য দেখার পর তার পেটের ক্ষুধা চনমনিয়ে ওঠে। মনে পড়ে যায় চানপুরী ইলিশ মাছের সুঘ্রাণ। গরম ভাতের সাথে গরম ইলিশ ভাজা। কচি বারোমাসি কাঁচামরিচ লবন। ইলিশের গন্ধে শতবর্ষী ছানু ঠাকুরের মায়ের অভিশাপ। মর মর মাছ, মাংস খা নরকে যা। নারায়ণ সব দেখছেন। নরক ছাড়া তোদের গতি নাই। ছানুর মায়ের কুঁজো শরীর ,কামরাঙা গাছ। পুকুর ঘাট। পুকুরে ভেসে বেড়ানো হাঁস। সকলই কেবল ছবি।
আলী নগরের জাবেদ মেম্বারের ইলিশের আড়তে ইলিশ আশা শুরু হলেই প্রতিদিন পাতে পড়ত ইলিশ। অসম্ভব স্বাদের ইলিশ এক সময় আর ভালো লাগত না। এখন ইলিশের ছবি দেখেই তুষ্ট থাকতে হয় সুমনকে।
জালালাবাদ ট্রেন সকাল বেলা বরমচাল স্টেশনে পৌঁছত। চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিয়ে সারারাত বিভিন্ন স্টেশনে থেমে থেমে ইলিশ মাছ নামিয়ে দিয়ে আসত। প্যাসেঞ্জার বগির পাশাপাশি মাছ ও অন্যান্য মালামাল পরিবহনের জন্য থাকত দু তিন বগি। সুরমা মেল ও জালালাবাদ ট্রেন প্রায় একই সময়ে পাড়ি দিত বরমচাল। সুরমা মেল আসত ঢাকা থেকে। সুমন যেদিন বাবার দোকানে বসা থাকত সেদিন গুলিয়ে ফেলত কোনটা সুরমা মেল আর কোনটা জালালাবাদ। সতুবাবু ছেলেকে শিখিয়েছিলেন লাল ডাব্বা ওয়ালা ট্রেন দেখলে বুঝবে এটি সুরমা মেল। ডাকের গাড়ি। পরে অবশ্য আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করেছিল সুমন,তাদের দোকানে কাজে সাহায্যকারী উস্তার মিয়া যে ট্রেন আসলে উড়াল দেয় সে ট্রেনের নাম জালালাবাদ। উস্তার মিয়া মাছের পেটি নামানোর কাজে সাহায্য করে। বিনিময়ে জাবেদ মেম্বারের আড়ত থেকে মাছ, মাছের খালি পেটি নিত।
বাবার হাত ধরে আসা যাওয়ার সময় অবাক হয়ে ইলিশ মাছ মাপার দাড়ি পাল্লার দিকে তাকিয়ে থাকত সুমন। ছোট একটি কাঁঠাল গাছের ঘাড়ের ওপর বেঁধে রাখা বিশাল পাল্লায় মাপা হত মাছ। পাইকার এসে ভরে যেত আশেপাশের এলাকা থেকে। নিলামকারীর দর ডাকার সুর খেলার মাঠ থেকেও শোনা যেত। সুমন আজ এক বিশাল স্মতি ভাণ্ডার। এই মুহূর্তে ভিক্ষা নামের কোন চিন্তা তার মাথায় নেই। সে এখন মায়ের বাপের আদরের ছেলে সুমন। সুখ আর অনাবিল আনন্দ ভোগের জন্য তার জন্ম হয়েছে বরমচালে।
সতুবাবু ছিমছাম পরিপাটি থাকতেন সবসময়। তার চলাফেরা দেখে মনেই হত না এই মানুষটা নিরাশ্রয়। তার নিজের বাড়ি নেই, ঘর নেই। যে দোকান সতুবাবুর পান ভাণ্ডার বলে সবাই জানে, সেটা রেলের কাছ থেকে লিজ আনা রানাবাবুর দোকান। সাজানো সংসারে অভিনয় করেছেন সতুবাবু। মঞ্চ থেকে নামার পর সতুবাবুর উছিলায় গড়ে ওঠা নাটকের দলের অন্যতম সদস্য সুমন টের পায় বাবার বিদায়ের সঙ্গেই শেষ হয়েছে নাটক। এবার শুরু সত্যিকারের জীবন। এই জীবনে সুহৃদ বলে কেউ নেই। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সকলেই প্রতিপক্ষ।
পৌষ সংক্রান্তি এলে সতুবাবুর ঘর বড় মাছ, নারিকেল, বিরইন চালে ভরে যেত। এত ইয়ার -দোস্ত , শুভাকাঙ্খী র উপহারের লাইন লেগে যেত। সতুবাবু কেউকেটা কেউ নয়। মেম্বার নয়, চেয়ারম্যান নয়। শুধুই ভালোলাগার কারণে ভালোবাসা। এক খিলি পানের বিনিময়ে তিনি যে টাকা নিতেন তার সাথে ফেরত দিতেন হাজার গুণ বেশি মিষ্টি আচার ব্যবহার। সুমনের কাছে বারবার একটি প্রশ্ন উঁকি দেয়, সমাজের কাছে স্বজ্জন মানুষ কী তাহলে এরকম হয়। ভোলাভালা, বৈষয়িক চিন্তাহীন। নিজের ঘর নেই বাড়ি নেই। এ যেন ঘুঘু পাখির সংসার। অন্যের কাঁঠাল গাছের ডালে বাসা বেঁধে ডিম পাড়া বাচ্চা ফুটানো। অথচ সকালে বাসার বাইরে গেলে বিকালে ফেরার আশা নেই। সতুবাবুর বেলায় এরকমই হয়েছিল। আরো আট দশজন মানুষের মত আখের গোছানোর চিন্তা ছিল না সতুবাবুর মাঝে। এর নাম সততা না উদাসীনতা ?
হাঁটতে শেখার আগেই বিদায় নেওয়া পিতাকে কাঠগড়ায় তুলতে চায় সুমন। কিন্তু কী লাভ তাতে? কে ফিরিয়ে দেবে প্রশ্নের উত্তর? প্রকৃতির বুকে যে ভাঙ্গা গড়ার খেলা চলছে সকলেই সুমনকে ঠেলে দিবে সেদিকে। ওটাই সহজ রাস্তা। মগডালে বসে পাকা আম খেতে খেতে নিচে অপেক্ষমান কাঙাল মানুষকে জ্ঞান দেয়ার মজাই আলাদা। এদের আধুনিক নাম মোটিভেশনাল স্পিকার ।
লোভী মানুষ মোটিভেশনাল স্পিচ নামে গোগ্রাসে গিলছে এসব ভাণ্ডামী।
কানাইঘাট জেলাপরিষদ ডাক বাংলো থেকে অনতিদূরে শীতের শুকনো নদীর পাড়ে এখনো বসে আছে সুমন। বাজারের প্রান্তে এরকম কত লোকই বসে থাকে। কে কার খবর রাখে?
কিন্তু আজ একজন তার খবর নিল। তাকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করল ভাতিজা তুমি এখানে কী কর ? তার নাম জিতু পীর। বরমচালের মানুষ। ভণ্ড পীরালি ভেলকি তার জীবিকার বাহন। সতুবাবুর পানের ভক্ত ছিলেন জিতু পীর। সুমনকে সে নিয়ে আসে একটা হোটেলে। হোটেলের মালিক তার মুরিদ। খুব সম্মানের সাথে জিতু পীরের হাতে থাকা মুরগীকেও যত্নের সাথে রাখল ক্যাশ কাউন্টারের পাশে। সুমনের জন্য আসল ভাত মাছ মাংস। জিতু পীর বললেন খা বেটা খা, পেট ভরে খা। তোর এই পীর চাচা থাকতে কোন চিন্তা নাই।
বরমচাল রেল স্টেশনের উত্তর দিকে চার পাঁচশ কদম হেঁটে গেলেই জিতু পীরের বাড়ি। বেটে হলেও পেটানো শরীর। সফেদ শশ্রু ,সাদা পাঞ্জাবী লুঙ্গি পরা জিতু পীর ম্যাজিক ম্যান। তাকে নিয়ে সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম গল্প চালু রয়েছে।
প্রচণ্ড ক্ষুধার মধ্যে যখন পেটে খাবার পড়ে তখন চিত্রপট পুরো পাল্টে যায়।কুকুর খুঁজে পায় সিংহের শক্তি। সুমনের সেই অবস্থা। ক্ষুধার্ত পেটে সে ধীরে ধীরে স্মৃতির গভীরে তলিয়ে গিয়েছিল।জিতু পীর তাকে টেনে তুললেন। সে টের পেল প্রদীপ দার সাথে দেখা হওয়ার পর সে নস্টালজিয়ায় ভুগছিল। তার সারাদিনটাই মাটি হয়ে গিয়েছে। সে ভিক্ষুক। ভিক্ষা পেশা তার। সংসার এবং নিজেকে বাঁচাতে হলে তাকে ভিক্ষা করতে হবে। লেখকের পেশা যেমন লেখা সেখানে মায়া মমতার স্থান নেই। দুঃখ দিনেও লেখককে ফরমায়েশী আনন্দের লেখা লিখতে হয়। তার কাজও মানুষকে নিজের ক্ষত, দারিদ্র্য, পঙ্গুত্ব দুঃখের কথা বলে অর্থ আদায় করা। সে মস্ত ভুল করেছে। জীবন থেকে একটা দিন হারিয়ে গেল। জিতু পীরের কাছে তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। জিতু পীরের কাছ থেকেই সে আজ দিনের ইনকাম পুষিয়ে নেবে।
যদিও সে জানে জিতুপীর একজন চিটার বাটপার প্রতারক। তবুও আজ জিতুপীরকেই জিততে চায় সুমন। জিতুপীরের কাছে দুঃখ বলার আগে আরেকবার স্টাডি করে পীরের অতীত জীবন সে দেখতে চায়। পরিচিত শিকার পেলে সে এরকম করে। সহানুভূতির ষোল আনা আদায় করে। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের ব্যবধানে জিতুপীরের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। তামাটে চেহারার মানুষটিকে এখনো জাদুকর মনে হচ্ছে তার। মনে পড়ে একটি ব্যাগ হাতে জিতুপীর সতু বাবুর পান ভাণ্ডারে এসেছেন। একটি পান খাওয়ার পর ব্যাগটি এগিয়ে দিয়ে বলছেন -দাদা মেইল আইজ দেরী। ব্যাগটা রাখৌইন। দামী মাল আছে। খেয়াল রাখবেন। সতুবাবুকে বিশ্বাস করত সবাই। সেই বিশ্বাসে যে কোনো মূল্যবান জিনিস রেখে যেতে দ্বিধা করত না। হয়তো সেই বিশ্বস্ত লোকের ছেলে হিসেবে আজ সুমনকে খাতির দেখাচ্ছে জিতু পীর। জিতুপীরের গাইল অপারেশনের কথা মনে পড়ে সুমনের। টিম আকারে কাজ করত জিতুপীর। প্রথমে একটি এলাকায় গিয়ে রেকি করতো। কোন বাড়িতে মহিলা মানুষ একা থাকে। বয়স্ক মানুষ ছাড়া কোন সমর্থ পুরুষ মানুষ কোন বাড়িতে নেই। কার স্বামী বিদেশ থাকে প্রভৃতি তথ্য সংগ্রহ করে আক্রমণ করত। আলোচিত এই ঘটনা ঘটায় জিতুপীর মাইজগাও এলাকায়। তার দল বাড়িতে যখন প্রবেশ করে তখন দেখে এক মহিলা ঢেঁকিতে ধান ভানছেন। আর ঘরে তার অসুস্থ শিশু কিছুক্ষণ পরপর কেঁদে কেঁদে ওঠছে।
জিতুপীর বাড়িতে ঢুকেই হক মাওলা বলেই ধ্যানে বসে গেলেন। ঠিক মাঝ উঠানে। কারো সাথে কোনো আলাপ নেই। কয়েক ঘন্টা ধরে ধ্যানে বসে আছেন। আরেক চেলা তাকে বাতাস করছে। কতক্ষণ পরপর চেলা ,বাবা বলে তার পায়ে লুটিয়ে পড়ছে। বাড়ির নিচে একজন পাহারা দিচ্ছে। মহিলা ঢেঁকিপাড় দেয়া বন্ধ করে ভিক্ষুক ভেবে কিছু চাল ও ফল এনে দিলেন পীরের সামনে। জিতুপীর হুংকার দিলেন -নাদান, তুই কিতা পাইছস? আমি ভিক্ষুক ! হক মাওলা। এবার চেলা এগিয়ে গিয়ে মহিলাকে বলল- বাবা কামেল পীর। বহু দূর থেকে আপনার বাড়ি এসেছেন। তার কাছে যা চাইবেন তা পাবেন। আর আপনি করলেন অপমান। আপনি মাপ চান।
মহিলার অন্তর খুবই সহজ-সরল। তিনি কী আর চাইতে পারেন? তার রুগ্ন শিশু ভালো হলেই তার সব পাওয়া হবে।পীরের কাছে বললেন বাবা আমারে মাপ করে দিন। আর আমার ছেলেটারে সুস্থ করে দিন। পীর আবার হুংকার দিলেন হক মাওলা।
আমি সব জানি, তোর ছেলের গাইলা অসুখ হয়েছে। তাকে গাইলে বসা। আমি ফু দেবো। মা ছেলেটাকে গাইলের মধ্যে বসালেন। পীরের নির্দেশ, তুমি এবার চাপ দিয়ে তুলে ধরো ঢেঁকি। আগ পাছ না ভেবে মহিলা তার শিশুকে গাইলের মধ্যে বসিয়ে ঢেঁকিতে পা দিলেন। অবস্থাটা এমন দাঁড়াল পা ছাড়লেই ঢেঁকি গিয়ে পড়বে শিশুটির মাথার ওপর। জীতুপীর বললেন- আম্মাগো তোমার ছেলে এখন ভালো হয়ে যাবে। তার জান প্রাণ এখন তোমার পায়ে। ঢেঁকি ছাড়লেই ছেলের সাথে তোমার ছেলের মাথাও ছাতু হয়ে যাবে। অত্এব চুপচাপ থাকো। সম্পদ বড় না সন্তান বড়? ভুল করো না আম্মা।
এই ফাঁকে চেলা মহিলার পুরো ঘর লুট করে নিয়ে চলে আসে। এইসব অপারেশন শেষ করে জিতুপীর আবার রেল স্টেশনেই আড্ডা মেরে কাটাতেন। পরবর্তী অপারেশনের ছক কাটতেন। সবই হতো বসে বসেই। ইদ্রিস মিয়ার চা স্টলেই গল্পগুজবের আকারে অনেকের কাছেই ফাঁস করতেন তার এসব অভিযান কাহিনী। আর এসব অভিযান কাহিনী ফুলেরতল বাজার হয়ে ভাটেরা ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে সিলেট পর্যন্ত চাউর হয়ে যেত।
সুমন আজকের দিন টা ব্যর্থ হতে দিতে পারে না। সে জানে তীর থেকে টেনে তোলা ব্যক্তিকেই সহজে বাঁশ দেয়া যায়। তাই জিতুপীরের লোমহর্ষক অতীত সুমনকে ভীত করে না। সে শুরু করে ভিক্ষা আদায়ের সর্বোৎকৃষ্ট কৌশল। আমি পঙ্গু। আমাকে একটি কাজ দিন। মা ,স্ত্রী -সন্তান নিয়ে মরতে বসেছি। আপনি না এলে সুরমায় আজই ডুবতাম।
আপনি আমায় বাঁচালেন। আপনিই আজ আমায় নতুন করে জীবন দিলেন। আপনি মানুষ নন ভগবান।
জিতুপীর হাসেন। তার বিখ্যাত গুয়ামুরী হাসি। যে হাসিতে বুঝা খুব কষ্ট কেউ হাসছে না কাঁদছে। জিতুপীর বুঝতে পারেন জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে উঠতি বয়সী খেলোয়াড়ের হাতে পড়েছেন আজ। চাইলেন সুমনের হাত থেকে ফসকে যেতে পারেন। কিন্ত না । সতুবাবুর কারণে সুমনের ওপর তার মায়া হয়। তাই তিনি হারতেও চান না আবার সুমনকেও নিরাশ করতে চান না।
সুমনকে বলেন, দেখ বাবা কেউ করো ভগবান না। স্বার্থের কারণে মানুষ আজ কাউকে ভগবান বানায় তো কাল তাকে বানায় অসুর। এ হলো জগতের খেলা। এই যে দেখ, তুমি নিজেই জান জিতুপীর চুর বাটপার। কিন্ত কী হয়েছে? ক্ষুধার্ত পেটে তুমি খেয়ে মুরগির রান খেয়ে আমাকে বানালে ভগবান। এখন আরও প্রশংসা করছ। ভবিষ্যতের কথা জান না তাই যা পার আমার কাছ থেকে হাতিয়ে নিতে চাইছ।
কোন যাত্রার শেষ স্টপেজে নামার এই এক সুবিধা,নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায়। বাস অনেকক্ষণ আগেই এসে পৌঁছেছে কানাইঘাট বাজারে। বাসের হেল্পারের হাতের স্পর্শ ঘুম ভাঙাল। চেয়ে দেখি কেউ নেই। সুমন,সতুবাবুর পান ভাণ্ডার, জিতুপীর কই ? কেউ তো নেই। হয়তো জিতুপীরের কথাই সত্য। পেটে ক্ষুধা নেই বলেই অনেকক্ষণ কোথায় হারিয়েছিলাম।
১৪১২২০২৩ সিলেট।
আরও পড়ুন: কুতুব
গল্প লেখক: পার্থ প্রতিম নাথ।