কবি নির্মলেন্দু গুণের আত্মশ্রাদ্ধ আমাদের প্রাপ্তি

 সে যাক আত্মশ্রাদ্ধ আর শ্রাদ্ধ যাই হোক এটা মানুষের জন্য কতটুকু দরকারি ?নির্মলেন্দু গুণ বাংলাদেশের কবিদের কবি। তিনি যদি ভাবেন শ্রাদ্ধটা খুবই আবশ্যিক; তবে পরকাল চিন্তায় কেন হতে হবে ? শ্রাদ্ধের শাব্দিক অর্থ শ্রদ্ধার সহিত দান করা। যেকোন সময় যে কেউ শ্রদ্ধার সহিত দান করে দাতা কর্ণ হয়ে যেতে পারেন। পরকাল চিন্তায় আগাম শ্রাদ্ধ সমাজে একটি বাড়তি উপদ্রব অনুষ্ঠানের সৃষ্টি করবে না ? প্রথমে সামর্থ্যবান মানুষ করবে। আস্তে আস্তে সম্বলহীন মানুষ পরকালের শান্তির আশায় ঋণ করে আগাম শ্রাদ্ধের আয়োজন করবে। ঋণের চাপে আত্মশ্রাদ্ধকারী সম্বলহীন তার পরকাল যাত্রা ত্বরিত করবে। কবি গুণ আত্মশ্রাদ্ধ করেই ক্ষান্ত হননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে টেনে এনেছেন আত্মশ্রাদ্ধে। তা কেন বাপু ? পরকাল চিন্তা সবার মনেই আছে এবং ছিল। তাই মিশরের মানুষ মৃত্যুর আগে পিরামিডে আগে থেকেই খাবার দাবার এমনকি দামি দাস-দাসী পর্যন্ত রাখত। ভাবতো মৃত্যুর পর এই খাবার তার কাজে লাগবে। মৃত্যুর পর এই পাথরের দাস-দাসীরা তার সেবা করবে। যে কবি প্রেমাংশুর রক্ত চেয়েছেন।নিজেকে একসময় মানুষ নয় অতি মানব ভেবেছেন। সাপকে অবলীলায় ঝাপটে ধরেছেন। সেই কবি কেন হঠাৎ করে পরকাল চর্চায় মেতে উঠলেন ? শ্রাদ্ধ শান্তি, পরলোক এগুলো তাহলে তাকে আক্রান্ত করেছে। যৌবনের সূর্য পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়লেই তাহলে মানুষ পরকালের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শাস্ত্রকে শস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। পরকালের সম্বল আহরণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু যারা ইহকালে রহে যায় তাদের জন্য রেখে যায় একটি দুঃসহ অনুষ্ঠানের। মৃত মানুষের পরকালের শান্তি কামনায় হৈ হুল্লোড় করে খাবার- দাবার,দান- খয়রাত, শ্রাদ্ধের মতো অনুষ্ঠান জনপীড়ার কারণ এখন সমাজে। দেখা যায় জীবদ্দশায় যে লোক খেতে পায় না, না খেয়ে মরে । সে লোকের শ্রাদ্ধ করে তার পরিবার, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে। মানুষ শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে কব্জি ডুবিয়ে মাছ, মাংস খাচ্ছে অথচ যার শ্রাদ্ধ সে হয়তো বা বেঁচে থাকতে কোনদিন পেট পুরে খাবার পায়নি। তাই শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানকে অনেকে সমাজের একটি ক্ষত হিসেবে দেখেছেন। একজন অভাবী মানুষের মৃত্যু তার পরিবারকে আরো বিপদের মুখে ঠেলে দেয় শ্রাদ্ধ চিন্তার কারণ। সমাজ শাস্তি হিসেবেই যেন শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানকে জিইয়ে রেখেছে। তাই কবি নির্মলেন্দু গুণ পরিবারকে চাপমুক্ত রাখতে জীবদ্দশাতেই তার শ্রাদ্ধ সারলেন। ২৪ শে অক্টোবর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ তারিখে আজকের পত্রিকা ছবিসহ ছেপেছে গুণের শ্রাদ্ধের খবর। কবির মতে জীবিত থাকা অবস্থায় নিজের শ্রাদ্ধ নিজে করতে পারা এই ধরণের আত্ম শ্রাদ্ধ নেত্রকোনাতে অনেকেই করেছেন। কবি আরো বলেন, ”এতে করে মৃত্যুর পর আর শ্রাদ্ধ করার প্রয়োজন হবে না। আমি অর্থ আত্মনির্ভরশীল মানুষ। নিজের কাজ নিজে করে যেতে চাই। আমার মৃত্যুর রপর পরিবারের লোকজনকে শ্রাদ্ধের জন্য চাপ পোহাতে হবে না। গুণ পরিবারকে চাপমুক্ত রাখতে মৃত্যুর এর আগেই শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করা হয়েছে।” 

জীবদ্দশায়একজন মানুষআরো কিছু অসুখী মানুষকে নিমন্ত্রণ করেছে খাওয়াবে বলে। কিছু বস্ত্র, অর্থ দান করবে বলে। বিনিময়ে সে মৃত্যুর পর তার আত্মার শান্তি চায়। অদ্ভূত একটা ব্যাপার যে মানুষ জীবনে শান্তি পেল না। সেই মানুষ মরণের পর শান্তির আশায় অনুষ্ঠান করছে। তাও একজন শ্রেষ্ঠতম বুদ্ধিজীবী। সমাজের একজন পথপ্রদর্শক। এটা মেনে নিতে অবশ্যই কষ্ট হয়। আদি পিতা মনু শ্রাদ্ধ সম্পর্কে যা বলেছেন, আপনি যদি শাস্ত্র মানেন তবে তা আপনাকে মানতে হবে। তবে আমি হলফ করে বলতে পারি মনুর নির্দেশনা ধৈর্য ধরে শুনলে আপনার মাথা বিগড়ে যাবার জোগাড় হবে। 

মনুসংহিতার তৃতীয় অধ্যায়ের শ্লোক নাম্বার ১২২ হতে শ্লোক নাম্বার ১৭০ পর্যন্ত মনু শ্রাদ্ধ ও শ্রাদ্ধের কর্তব্যাকর্তব্য সম্পর্কে বলেছেন। সংস্কৃত শ্লোক গুলো আমরা যদি অনুবাদ করি তাহলে দেখা যায় প্রতি মাসেই আমাদের পিতৃ পুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধের আয়োজন করতে হচ্ছে। শ্লোকগুলির অর্থ পড়লে মনে হবে ব্রাহ্মণরা নির্লজ্জ ভাবে শ্রাদ্ধের নামে তাদের ভোজনও আরাম- আয়েশের ব্যবস্থা করেছেন। শ্রাদ্ধ যাতে ব্রাহ্মণদের স্থায়ী উপার্জনের ব্যবস্থা হয় তার জন্য অনেকগুলো বিধি-বিধান তৈরি করে দিয়েছেন মনু। শ্রাদ্ধে আমন্ত্রিত ব্রাহ্মণের প্রকার-প্রকৃতি ও নির্ধারণ করে দিয়েছেন মনু। যে ব্রাহ্মণ অধ্যাপনার বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করেন তাকে শ্রাদ্ধে আমন্ত্রণ জানানো যাবে না। মনু ব্রাহ্মণদের আহারের সময় কি কি ব্যবস্থা করতে হবে। কি রকম করে বসার স্থান দিতে হবে। কোন সময় ভোজনের আয়োজন করতে হবে, তাও পর্যন্ত বিধান দিয়ে দিয়েছেন। অথচ যে লোক পিতৃ পুরুষের মঙ্গলার্থে তে এই আয়োজন করেছে তার পিতৃপুরুষ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান এর ফলে কী পাবে তা বিস্তারিত কোথাও লেখা নেই। শুধু বলা হয়েছে ব্রাহ্মণদের খাওয়ানোর ফলে তার সাত পুরুষ পর্যন্ত পরলোকে শান্তিতে থাকবে। পিতৃপুরুষ শুধু শান্তি আর শান্তি পাচ্ছেন। যেখানে শান্তি শব্দটাই আপেক্ষিক। আর ভোজনটা বাস্তবিক। জগতে ব্রাহ্মণ বসে মাংস ভক্ষণ করছেন আর পরলোকে পিতৃপুরুষ শান্তিতে আছে। এই ২০২৩ সালে আমরা কি এসব ভাবতে পারি ! হাজার বছর,লক্ষ বছর,কোটি বছর পাড়ি দিয়ে এসে সভ্য মানুষ এই ভাবনা ভাবতে পারে? শ্রাদ্ধের খাবারে যাতে ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য কেউ ভাগ না বসাতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে মনুসংহিতাতে। বলা হয়েছে যে ব্যক্তি মিত্র লাভের উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধের আয়োজন করবে সে শ্রাদ্ধমিত্র নামে অভিহিত হবে এবং স্বর্গচ্যুত হবে। 

শ্রাদ্ধের অর্থ ব্রাহ্মণকে দান না করে যদি অব্রাহ্মণকে দান করা হয় তবে তা কখনো পরলোকে যাবে না। তা ইহলোকেই থেকে যাবে। অর্থাৎ পরলোকে অবস্থানরত মৃতের কোন কাজে লাগবে না। কিরূপ বালখিল্যশ্লোকে ব্রাহ্মণদের অর্থ উপার্জনের রাস্তা করে দেয়া হয়েছে। যে শ্রাদ্ধের আয়োজন করেন তাকে এখনো ব্রাহ্মণেরা এই নিয়ম-কানুন গুলো বেঁধে দেন। আর এর একমাত্রই উদ্দেশ্য নিজেদের ভোগএবং তৃপ্তি সাধন। কিন্তু আধুনিক সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি যদি শ্রাদ্ধকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেন তাহলে বিষয়টা কি রকম হয়? 

শুধু তাই নয় আরো একধাপ এগিয়ে আত্মশ্রাদ্ধের মতো একটা বিষয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন এই সময়ে কতটুকু প্রয়োজন সে প্রশ্ন আমরা কবি ভক্ত হিসেবে রাখতেই পারি। আমি তো মনে করি কবি নির্মলেন্দু গুণ কাব্য চর্চায় বাংলা সাহিত্য কে যা দান করেছেন পরলোকের শান্তির জন্য আপনার আর দানের প্রয়োজন নেই। আপনার কবিতার একটি পংক্তি কি এই সামান্য বস্ত্র আর ভোজনের তুল্য হতে পারে ? হ্যাঁ ব্যক্তি হিসেবে শ্রাদ্ধ- শান্তি- স্বস্ত্যয়ন সব করার অধিকার আপনার আছে। তবে একথা মানতে হবে যে পরিবারকে আপনি শ্রাদ্ধের দায় থেকে নিষ্কৃতি দিতে চেয়েছেন আত্মশ্রাদ্ধ করে, ধর্মশাস্ত্র তা কখনো হতে দেবে না। কারণ হিন্দুরা যে কোনো অনুষ্ঠান বা যজ্ঞ শুরুর পূর্বে পিন্ড দান বা শ্রাদ্ধ করে থাকে। এই শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান না হলে ধর্ম মতে কোন অনুষ্ঠান শুরু হতে পারে না। এমন কি বিয়ে পর্যন্ত না। বাংলা ভাষাভাষীরা শ্রাদ্ধ কে অপচয় অর্থে ব্যবহার করেন অনেক সময়। যেমন প্রচুর অপব্যয়ে কোন প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে দেখলে আমরা বলি অর্থের শ্রাদ্ধ হচ্ছে। খুবই ক্ষুব্ধ কর্মব্যস্ত মানুষকে আপনি যদি অহেতুক প্রশ্ন করেন, কী করছ ? সে রাগে জবাব দেবে বাপের পিন্ডি দিচ্ছি। দেখতে পাচ্ছো না ?সমাজ আসলে এরকমই যার যখন খুশি শ্রাদ্ধ করছে।

 আরও পড়ুন: কুুতুব

  লেখক: পার্থ প্রতিম নাথ।


parthiv

parthiv Means Earth Related. We Want To Learn Life Of Earth.

Post a Comment

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال