সীতাহার,অলংকরণ: পৃথা দেবী। |
এই সীতাহার নিয়েই লঙ্কাকাণ্ড
ঘটে গেল মায়াপুরের বড় বাড়িতে। বেশ কয়েক বছর আগে দুর্গা পূজায় দশমীর দিনে ঘটে এ ঘটনা।
আমার বয়স তখন পনর ষোল আর বিনোদ দাদার ঊনিশ বিশ। জেঠি মা একমাত্র পুত্রকে সাজিয়ে গুছিয়ে
রাখেন। আমরা ভাইবোনেরা একপাল। মা এত সাজাতে পারেন না। এইতো সেদিন চোখের সামনেই জেঠিমা
বিক্রি করলেন কয়েক মন ধান। কত কী বানিয়ে দিলেন বিনোদ দাকে। আমি অত মাথা ঘামাই না ।
বিনোদ দার যা আমারও তা। আমরা দুই ভাইয়ের গলায়গলায় ভাব। মায়াপুরের গণ্ডগোলের সময় আমরা
দুই ভাই ঐ বাড়িতে ছিলাম। হয়েছিল কী, বোয়াল মাছের পেটের ভেতর থেকে বেরিয়েছিল এক অরিজিনাল
সোনার হার। সীতাহার। আর সেই হার নিয়েই বাড়িশুদ্ধ মানুষ আর পুজায় বেড়াতে আসা আত্মীয়
স্বজনের মাঝে শুরু হয়েছিল ঘুটোমাইর। কারো কথা কেউ শোনে না। যে দেখে যে শোনে, সে বলে
এ সীতা হার আমার। আমি স্নান করার সময় পুকুরে ফেলে এসেছি। আর ঐ রাক্ষুসে বোয়াল গিলেছে।
এক সীতা হার তার দাবিদার তিন চারশ মানুষ। তার উপর বড় বাড়িতে উৎসবের শেষ দিন । চরম দিন দশমির দিন। অবশ্য বড় বাড়ির মুরব্বি বামা নাথ সামাল
দিতে পেরেছিলেন দুর্ঘটনাটি । যার হার তাকেই বুজিয়ে দিয়েছিলেন অবশেষে।
বছরে ঐ একদিন বড় বাড়ির জন্যে
বিশেষ দিন। দুর্গাপূজার দশমীর দিন। মায়াপুরের বড় বাড়ির দুর্গাপূজার ঐতিহ্য অনেক পুরোনো।
ঐ সময়ের জীবিত সকলেই স্বীকার করেন বুজ হওয়ার পর থেকেই বড় বাড়ির পুজার গৌরব শোনে আসছেন।
বড় বাড়ি আমার মায়ের মামা বাড়ি। তাই আমরা বিশেষ নিমন্ত্রণ পেতাম। ছোটবেলায় বাবা মার
সাথে গরুর গাড়িতে যেতাম। আর এখন আমি আর বিনোদ দা হেঁটেই চলে যাই। উত্তর দিকে হাঁটলেই
কয়েক ঘন্টার পথ। হরিপুরের তিন তালগাছটা পাড়ি দিলেই তুলাপুর। ইদ্রিস চেয়ারম্যানের বাড়ি
পার নাহতেই মেড়াবই ,আর মুমিনছড়া চা বাগান পার হলেই দেখা যায় মায়াপুর। একসময় নাম ছিল
মোহরাবপুর কী সুন্দর নাম। চারিদিকে ছোট ছোট টিলা আর মাঝে মাঝে গুচ্ছ বাধা এক একটি বাড়ি।
এক সময় বাঘ ও অন্যান্য হিংস্র বন্য জন্তু বাস করত এ এলাকায়। মানুষের সংখ্যা বাড়ায় পশুরা
কমতে শুরু করেছে। মোহরাবপুর মায়াপুর হয়েছে। আট দশ মাইল রাস্তা হেঁটে এসে আমরা প্রথমে
বসতাম পুকুর ঘাটে। তারপর বামা নাথের ঘাটে হাত পা ধুতাম। বাড়িতে প্রায় দুশ মানুষের বাস।
পরিবার প্রায় দশটি। কিন্তু আমরা কখনো আলাদা করে কোন পবিারকে চিনতাম না। চিনতাম উতরো
ঘর দৌখনো ঘর, মাঝর ঘর ফুবর ঘর ফইসমো ঘর। কে কোন ঘরের বাসিন্দা তার খবরই নিতাম না। জানতাম
কে দাদু, কে কাকু, কে পিশি, কে দিদি আর কিছু চেনার দরকারই পড়ত না। যে ঘরেই যেতাম আদর
পেতাম। খাবার পেতাম। বিশ্রামের জায়গা পেতাম। এত এত উৎসবমুখর নরনারী শিশু বৃদ্ধ সবাই
আপন। যেন বৃন্দাবন্। কেউ নয় অনাত্মীয়। পুজা শেষ হলেও আসতে মন চাইতো না।
বড় বাড়ির নিয়ম ছিল সারা বছর বিশাল
পুকুরে কেউ জাল ফেলে মাছ ধরতে পারবে না। সকলেই
পুকুর ব্যবহার করবে। যত্ন নিবে। দশমির দিন হাকালুকি হাওর থেকে আসবে স্পেশাল জেলে দল।
খুব ভোরে জাল ফেলবে তারা। জাল পড়বে শিবের পাড় দিয়ে আর উঠবে বামা নাথের ঘাট দিয়ে। এবারও
ব্যতিক্রম হয়নি। খুব ভোরে জাল নিয়ে গফুর মাইমালের দল রেডি। সূর্য্যের আলো ফোটার সাথে
সাথে বামা নাথ তার ঘাটে হাজির হলেন। শিব মন্দিরের ঠিক উল্টো দিকের ঘাটে দাঁড়িয়ে বড়
বাড়ির জীবন্ত ভৈরব বামা নাথ হাঁক দিলেন, জাল ফালাও গফুর। এর আগেই লোকে লোকারন্য হয়ে
গেল পুকুর পাড়। পুকুর নয যেন বিশাল দিঘি। বাড়ির প্রতিটি লোক, মোহরাবপুর গ্রামের আবাল
বৃদ্ধ সকলে কাঙালের মত এ দিন টির জন্যে, এ
সময়ের জন্যে সারা বছর অপেক্ষা করে। মানুষ সব সময় খাবারের জন্যে কাঙাল হয় না। মনের খাবার
এ উৎসবের জন্য কাঙালিপনা যেন বাঙালির চিরায়ত স্বভাব। এবার অনেকেই জানেন ধরা পড়তে পারে
দৈত্যাকৃতির এক রাঘব বোয়াল। গতবার গফুরের ছেলের মাথার উপর দিয়ে লাফ দিয়ে বেঁচেছিল।
এবার সকলের দাবি বোয়াল যেন ধরা পড়ে। তাই সার্কাস দেখার মত লোক পুকুর পাড়ে। আমি আর বিনোদ
দা বামা নাথের পাশেই আছি। মাছ ধরাও দেখব আর ঐ বুড়ো শিবের কেরামতিও দেখব। যার হাতের
ইশারায় বড় বাড়ি এমনকি মোহরাবপুর ওঠে বসে।
বিশাল জাল আর জন পঞ্চাশেক জেলে আক্রমণ করেছে পুকুর । মাছ যেন টের পেয়েছে দুর্য্যোগের। ছোট বড় সব ধরণের মাছ শুরু করেছে লাফালাফি। দু একটা পাড়েও উঠে পড়েছে। মাছেদের মধ্যে পালানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যে বাঁচার জন্যে যত হন্যে হচ্ছে সে তত দ্রুত ধরা পড়েছে। যে যার মত লাফাচ্ছে। একেই বলে মাৎসন্যায়। জলাশয়ে একটু আগেও বোধ হয় রাজনীতি ছিল। উচুঁ নিচু ভেদাভেদ ছিল। বিভেদ ছিল বৈষম্য ছিল। সুখ ,শান্তি, অশান্তি সবই ছিল। । একটি জালের তাণ্ডবে নিমিষেই সব ছারখার। মাছ ধরা শেষ হয় এক সময়। বড় রাঘব বোয়ালটি ধরা পড়েছে। যত বড় ভাবা হয়েছিল সে আসলে তত বড় নয় ।
পুকুর, অলংকরণ: পৃথা দেবী। |
তার চেয়ে অনেক বড়
রুই কাতলা ধরা পড়েছে। বোয়ালের গতবারের পালিয়ে
যাওয়া তাকে লাইমলাইটে এনেছে। মাছের সাম্রাজ্য আর মানুষের সাম্রাজ্য একই রকম।
সমাজে ঘাপটি মেরে থাকা রুই কাতলা গুলোকে সহজে ধরা যায় না। জাল দিয়ে টেনে ধরতে হয়। এখন
মাছ বাছাই হবে। সবচেয়ে বড় মাছগুলো বাছাই করবেন বামা নাথ। এই মাছ গুলো দিয়ে মহাভোজ হবে।
বাড়ির সবাই আত্মীয় স্বজন পাড়া পঞ্চায়েত সকলেই উঠোনে বসে এক সাথে ভাত মাছ ডাল খাবেন। ভোজের মাছ বাছাই হয়ে
গেলে মাছ বাচবে গফুর মাইমাল। সে তার ইচ্ছেমত মাছ সংগ্রহ করবে। কেউ তাকে বাধা দিবে না।
কারণ এটা বামা কর্তার নির্দেশ। গফুরের মাছ নেওয়া শেষ হলে বাড়ির মাঝারি টাইপের মুরুব্বি
সুনীল, অনীল, অখিল, কোকিল আরো কয়েকজন মিলে মাছ ভাগ করে দিবেন পাড়ার মুসলমানের মধ্যে
কারণ ভোজে তাদের নিমন্ত্রণ নেই। বড় বাড়ির উপর সবার অধিকার সেটা বামা নাথের কথা। আর
বামা নাথের কথা মানেই বিচার শেষ।
মাছগুলো রাখা হয়েছে বাহির বাড়িতে। গোলাঘরের পাশে
খালি জায়গায়। পুরুষেরা আঁশ ছাড়িয়ে এগুলো পাঠিয়ে দিবে ভেতর বাড়িতে। বাড়িতে উৎসবের মাছ
মাংস কাটার জন্যে একটি ঘর, সবজি কাটার এক ঘর রান্নার জন্যে আলাদা পাকশাল রয়েছে। এ বাড়িতে
ধর্মীয় রীতিতে রসনা বিলাস হয়। আচার বিঘ্ন হলে মহাদেব অখুশি হবেন। এরা নাথ। মহাদেব শিব
ভক্ত।
ভোজের রান্নার জন্যে বাছাই করা
মাছ গুলো এখন চলে আসবে অবলা দিদির কাছে। অবলা দিদিই উৎসব পার্বনে রান্না বান্নার নেতৃত্ব
দেন। বাবুর্চি আসেন মির্জাপুর থেকে। সবাই যার যার কাজ করে। শুধু অবলা দিদিই সবার কাজ
করেন। তার নিজের কোন কাজ নাই। সাধ নাই, আহ্লাদ
নাই। সকলকে খুশি রাখাই যেন তার ব্রত। দিনরাত এক করে বড় বাড়ি আর তার পরিবারের জন্যে
কাজ করে যাচ্ছেন এই পঞ্চাশোর্ধ বিধবা। আমি কোনদিন স্থির করতে পারিনি বাড়ির কোন ঘরটি
তার নিজের ঘর। কারণ যেখানেই প্রয়োজন সেখানেই অবলা দিদি। কোথ্থেকে আসছেন, কিভাবে আসছেন
সেটা বড় কথা নয়। অবলা দিদি না থাকলে অচল উৎসব। এত গুরুত্বপূর্ণ মানুষটা যেন তারপরও
ছিলেন অবহেলিত। তার মুখে হাসি ছিল সবসময়। কিন্তু হাসির মধ্যে কি এক প্রচ্ছন্ন বেদনা
যেন খেলা করত সবসময়। শুনেছিলাম কোন এক দাদুর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ছিলেন এ অবলা দিদি।
তার সন্তানেরাও দ্বিতীয় শ্রেণীর জীবন বেছে নিয়েছিল। প্রথম পক্ষের সন্তানেরা শিক্ষা
দীক্ষায় উন্নত আর অবলা দিদির ছেলেরা করত হাল
চাষ চরাত গরু। তারা সকলেই নিজ নিজ অবস্থা মেনে নিয়েছেন এবং তারা সুখে আছেন এমন বিষয়
আমার মনে হত অভিনয়। স্বেচ্ছাদাস মনে হত তাদের। বামা নাথ খুব পছন্দ করতেন অবলা দিদিকে।
এমন নিবেদিত প্রাণ কর্মীকে কে না ভালোবাসে ? তাছাড়া অবলা দিদির ছিল আলাদা এক ধরণের
ব্যক্তিত্ব। সর্বংসহা। ধরণীর মত। বোঝা পিঠে নিয়েছেন, দেবে যাচ্ছেন অথচ বোঝা নামানোর
কোন চেষ্টা নাই। তেষ্টা নাই। ক্লান্তি নাই। বিরামহীন যোদ্ধা।
এই অবলা দিদিই ঘোষণা দিলেন বড়
বোয়ালটির পেটে যে সীতাহার পাওয়া গিয়েছে তা খাঁটি স্বর্ণের এবং ওজন প্রায় দেড় ভরি। হই
চই পড়ে গেল এক ঘোষণায়। দশমী উৎসবের আনন্দ আত্মসমর্পন করল এক বেওয়ারিশ স্বর্ণের হারের
কাছে। সবারই চোখে লোভ যদি আমি পাই। অবলা দিদির চোখ একেবারে মরা মাছের চোখের মত। স্বর্ণে
লোভ নাই তার। হাত খালি, গলা খালি একটা নাকফুলও নেই নাকে। সাদা শাড়ির সাদা মানুষ মালিক
খুঁজছেন এ সীতাহারের। সীতাহার বড় বাড়িকে ছোট ছোট বাড়িতে রূপান্তরিত করল। সবাই ভাগে
ভাগে আলাদা হয়ে হারের মালিকানা দাবি করে প্রস্তাব পাঠাল অবলা দিদির কাছে। মায়াপুর
বড় বাড়ি হঠাৎই অচেনা হয়ে ওঠে অবলা দিদির কাছে। সবাই যার যার পরিবারের হয়ে মালিকানা
দাবি করছে। তার পরিবার নাই। তার হয়ে সীতাহার চাইবার কেউ কোথাও নাই। হায়রে অবাক দুনিয়া।
রাজা সলোমনের গল্প বলেছিলেন বামা নাথ। স্বর্ণের কাছে হেরে যান কিং সলোমন। অবলা দিদি
শুনতে জানেন বলতে নয় তাই থেমে যান।
অনেকে হারানো ধন ফেরত পেলে দুর্গার
চরণে কিয়দাংশ অর্পনের বাসনা ব্যক্ত করছেন। তাও ফল লাভ হচ্ছে না।
বামা নাথ আর অপেক্ষা করতে পারেন
না। সমাগত অতিথিদের যথাযথ সম্মান নিবেদন করে বললেন, আপনারা সবাই আমাদের ক্ষমা করবেন।
এবারে দশমীর উৎসবের মহাভোজ যথাসময়ে হলো না। তবে কিছুক্ষণ পরেই আমরা ভোজ শুরু
করব। আপনারা কেউ ভোজ গ্রহণ না করে যাবেন না। এ আমার একান্ত মিনতি।
বাড়ির সবাই কে পূজা মণ্ডপে ডাকা
হলো। অবলা দিদির হাতে সীতাহার। কাগজে মোড়ানো। বামা নাথ বললেন, কারো বর্ণনার সাথে সীতাহারের
মিল পাওয়া যায়নি। তাই একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সীতাহার এ বাড়ির কারো নয় ।
উপস্থিত বাড়ির সদস্যদের মন কালো
হয়ে গেল। হয়তো বা কেউ যে লালা গিলছেন তাও তিতা লাগছে এ মুহূর্তে। নিজেদের পুকুর, নিজেদের
ঘাট, নিজেদের বোয়াল। শুধুই প্রমাণের অভাবে ফস্কে গেল সীতাহার।
বামা নাথ ভরাট গলায় হাঁক দিলেন,
বাদেসেনের পুলিনের ছেলে প্রতুল কি আছ? থাকলে সামনে আস। সকলে অবাক প্রতুল কেন? অত মানুষ
থাকতে প্রতুল কেন?
সবার কৌতুহলের শেষ নেই।
বুড়ো বামা নাথ কে বুঝা কঠিন কাজ। প্রতুল আমার আদরের ভাগ্নে। আমার বোনের মেয়ে জলদার
বড় ছেলে। বাদেসেন বাড়ির মান বাড়াবে সে। তার গুণ কীর্তনে তোমাদের গাত্র দাহ হবে জানি।
কারণ তোমাদের সীতাহারের সাথে প্রতুলের মহিমা প্রচারের কোন সম্পর্ক নাই। এটা তোমাদের
কাছে নাই কিন্ত অবাক হলেও সত্য আমার সম্পর্ক আছে। হারের সম্পর্ক। সীতাহারের সাথে আজ
আমার হারের গল্প সংযোজিত হলো। আমি ভাবতাম আমার বিচার সব সময়ই সঠিক। এই সীতাহার আর প্রতুল
আমার এত দিনের অহংকার চূর্ণ করে দিল। আজ থেকে আমি আর তোমাদের মুরুব্বি নই। তোমাদের
দায়িত্ব তোমাদের। সুনীল, অনীল , অখিল, কবিন্দ্র সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় । হচ্ছেটা কী?
সীতাহার,প্রতুল, বামা নাথের পদত্যাগ একটা আরেকটার সাথে কোনভাবেই মিলছে না। কেমন আউলা
ঝাউলা হয়ে গেছে সবাই। মা দুর্গার কাছে মেয়েরা রোদন করে প্রার্থনা করছেন, সীতাহার চাইনা
মা আমাদের সুখ শান্তি ফিরিয়ে দাও।
বিচার সভা, অলঙকরণ: পৃথা দেবী। |
বামা নাথ বলতে থাকলেন বড়বাড়ির
লোকের উদ্দেশ্য। আমি জানি তোমরা এখন মুখে কিছুই বলবে না। সীতাহার ছেড়ে আমাকে চাইবে।
কারণ তোমরা আমাকে ভালোবাস বিনা প্রশ্নে। কিন্ত লোভের কাছে ভালোবাসা হেরে যায় । সেই
সময় ভালোবাসার পরীক্ষায় পাশ করতে হয় । সে জ্ঞান আমার ছিল না। তাই আজ আমি হেরে গেছি
সীতাহারের কাছে। অজ্ঞতার দায়মাথায়নিয়ে আমি পদত্যাগ করলাম। তবে সীতাহারের ফয়সালা আমি
করে দিব।
সবাই মর্মাহত। শোকে আকাশ যেন
মেঘে ঢাকা পড়েছে। বামা নাথের মত ব্যক্তিত্ব ব্যাথা পেয়েছেন । পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজনের
কেউ মেনে নিতে পারছেন না। মহাভোজের চিন্তাই কারো মাথায় নাই।
কবিন্দ্র বললেন জেঠামশাই জানি
আমরা দুঃখ দিয়েছি। কিন্ত আমরা না জেনে করেছি। আমরা ক্ষমার অযোগ্য। তবুও ক্ষমা আপনাকে
করতে হবে। আপনি ক্ষমা না করলে আমরা যাব কোথায় ? তার আগে দয়া করে সীতাহার আর প্রতুলের
বিষয়টা বলুন। আজ দশমীর দিন। আমাদের উৎসবের আয়োজন আমরা নষ্ট করেছি সীতাহারের লোভে। আর
ভুল করতে চাই না। দয়া করে খোলে বলুন।
বিচারক বামা নাথ যেন মারাত্মক
অপরাধের কঠিন রায় শোনাবেন। পিনপতনের শব্দ নেই। আবার শুরু করলেন বামা নাথ।
প্রতুল আর তার ভাই বিনোদ এল সপ্তমীর
দিন। আমার ঘরে এল দেখা করতে। দণ্ডবৎ প্রণাম করল দুজনেই। জেঠাত খুড়তুতো ভাইয়ের মিল দেখে
আমি আনন্দ পেলাম। প্রতুলের সাথে গল্প করতে আমার বরাবরই ভাল লাগে। প্রতুল মেধাবী পড়ুয়া
ছেলে। সে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র হয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রদের অংক কষে দিত। বাইবেল ,গীতা,
কোরআন সব পড়ে এ বয়সে । জ্ঞানীর সাথে কথা বলার আনন্দই আলাদা। আলাপের এক ফাঁকে আমার চোখ
পড়ে বিনোদের গলার স্বর্ণের হারের দিকে। বামা নাথ হাঁক দিলেন বিনোদ কই?
বিনোদ পাশেই ছিলেন। সামনে এসে
দাঁড়ালেন। সকলে আগুন চোখে বিনোদের গলার দিকে তাকাল। কিন্ত খালি গলা দেখে আর বিষ্মিত
হলো। নাটক তাহলে শেষ হয়নি ।
বামা নাথ বলতে লাগলেন, আমি চাইলাম
প্রতুল কে একটু জব্দ করি। জ্ঞানীর সাথে জ্ঞান লাভ করতে হলে খেলতে হয় । বিনা মন্থনে
দুধ থেকে ঘি হয় না। আমি বললাম বিনোদ তোমার কেমন ভাই ? তার গলায় স্বর্ণের হার, তোমার
গলায় নাই।
প্রতুল হেসে বলল দুই ভাইয়ের একই
গলা একই সুর একই আওয়াজ, তাহলে হার দুটো দিয়ে কী হবে মামা ? আমরা দুই ভাই নিজেকে জানার
জন্য পড়ছি শিখছি। স্বর্ণের চেয়ে সম্পর্ক আমাদের কাছে মূল্যবান। তাই স্বর্ণ বা সম্পদ
লোভ নেই। আমরা খাঁটি মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছি। প্রতুলের কথায় আমার হিংসে হলো। আমিও
তাকে শুনিয়ে দিলাম,বড় বাড়ির লোকজন বড় দিলের। এদের কাছেও স্বর্ণের চেয়ে সম্পর্কের মূল্য
বেশি। তোমরা আমার কথার এই দিলে প্রতিদান। প্রতুল ঠিকই বলেছিল জ্ঞান আবেগের বিষয় নয়
। জ্ঞান চর্চা আর অনুশীলনের ফসল।
বোয়ালের পেটে কোন সীতাহার পাওয়া
যায়নি। এটা বিনোদের গলার হার। তাই সীতাহারের বর্ণনায় সকলেই ফেল করেছ। অবলা আমাকে এ
কাজে সাহায্য করেছে।
সবারই মাথায় হাত।
০৪-০৫-২০২৩ বাগবাড়ি, সিলেট।
আরও পড়ুন: হাইনি
লেখক :পার্থ প্রতিম নাথ