কেঁদো না বন্ধু। এগুলো ঘটে যাওয়া ঘটনা। তুমার মনের অতলে হারিয়ে যায়নি। ঘুমিয়ে ছিল মাত্র। আমি হারালাম তুমি, তুমরা জাগবে বলে। জানো, আমাদের সমাজ বড় নিষ্ঠুর। দূরত্ব ঘোচাতে মৃত্যুর চেয়ে আর বিকল্প কোন পথ খোলা রাখেনি। মাতৃত্বের বন্ধন, পিতৃত্বের বন্ধন, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন, বন্ধুত্বের বন্ধন সবই সময় গ্রাস করে নেয়। শুধু মৃত্যুপাশকে বাঁধতে পারে না কেউ। দেখ আমি দার্শনিক টাইপের ছিলাম না কখনো। তবু তুমাকে এসব কথা বলছি কেন বুঝতে পারছি না।
আস বাঁশঝাড়ের চিপায় যাই। তুমার সাথে
নিরিবিলি একটু আলাপ করি।
সরি বন্ধু, বাঁশঝাড়টি আর নেই। দালান
বানাব বলে ঝাড়সহ একদিন
উপড়ে ফেলেছি। আমিই উপড়ে ফেলেছি
এই নিজের দু হাতে। এই
দেখ আমার হাত দু
থানায় এখনো ফুশকা পড়ে
আছে। প্রকৃতির কি মধুর প্রতিশোধ,
মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে আমাকে দূর করে দিল
পৃথিবী নামক গ্রহ থেকে।
আমি এখন নক্ষত্র, তারায়
তারায় নিজেকে খুঁজে ফিরি।
আজ আমি নিঃস্ব, রিক্ত।
তুমরা যারা আমার স্মৃতি
তর্পণ করছ, তুমাদের সামনে
আমি পূর্বের শেখর রূপে হাজির
হলে তুমরা মেনে নেবে ? সত্যি
আমি ফিরে আসলে আমার
শূণ্যতা পূরণ হবে ? কখনোই
এটা হবে না। হারিয়ে
যাওয়া মানুষ দীর্ঘকাল পরে ফিরে তার
পরিবার ঘুচিয়েছে এমন রেকর্ড গল্প
উপন্যাসেও কম পাওয়া যায়।
বরঞ্চ বিড়ম্বনার কেচ্ছাই বেশি। আর আমিতো মৃত।
তাও অপঘাতে। আমার আক্ষেপেই আনন্দ,
বিলাপেই আনন্দ। মনের ভ্রমে আমাকে
দেখলে ভূত দর্শন হবে।
হিন্দু যাবে রানা ঠাকুরের
কাছে, শেখর ভূত বিদায়ের
বিধান জানতে। মুসলমান যাবে ধলা মিঞাছাবের
কাছে বালা, মুছিবত দূরে রাখার বিধান
জানতে। কিভাবে আমাকে তাড়ানো যায় ত্রিসীমানা থেকে।
অবশ্য শেষ সময়ে আমার
অবস্থা এমনই হয়েছিল। কেউ
আমাকে সহ্য করতে পারছিল
না। আর আমিও কাউকে
একদণ্ড শান্তি দিতে পারছিলাম না।
এমনতো হওয়ার কথা ছিল না।
বড় আফসোস হয়, কেন এমন
হল বন্ধু ?
চেয়ে দেখ, মেযেটা আমার ভারি চশমার ফাঁকে বাবাকে খুঁজছে। জানে বাবা নেই, তবুও অবোধ শিশু কতক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে একসময় ভুলে যাবে। ও আমার শরীরের গন্ধ টের পায়। পাচ্ছে কি ? মনে হয় না। অশরিরী আত্মার কোন গন্ধ নেই। পরিচয় নেই। শুধুই বাতাস। মন্ধ বাতাস। গায়ে লাগলে অমঙ্গল হয়।
চল বন্ধু রাস্তাটি পার হই। বরমচাল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমার বিদ্যালয়। এ যেন আমাদের ঘরেরই অংশ। মাঝখানের পিচ ঢালা রাস্তা কোনদিন বাধা হতে পারেনি। বৃষ্টির দিনে আমার ছাতা লাগত না। বই খাতা কাপড় কিছুই ভিজত না। কি মজা আর গর্ব হত অন্যদের ভিজা কাকতাড়ুয়া চেহারা দেখে। দেড়টার ঘন্টা বাজলেই লাফ মেরে চলে আসতাম বাড়ির রান্নাঘরে। এ ঘর থেকে ও ঘরে আসার মত।
স্কুল শেষে বিকেলের খেলার মাঠ আবার স্কুলের মাঠ। এ যেন নিজেদের বাড়ির উঠোন। লাকড়ির আর শনের ভার নিয়ে স্কুলের মাঝখান দিয়ে যাচ্ছেন বিক্রেতারা আর এরই মধ্যে চলছে আমাদের খেলা। হা-ডু-ডু, ফুটবল, নুনদাই, ক্রিকেট। কত খেলা, কত বন্ধু। সবার উর্ধ্বে আজ আমি। খেলা, খেলাঘর সবই থেমে গেছে। অবশ্য সবদিন খেলা হত না। যেদিন বন্ধুরা আসত না। আমি বসে থাকতাম স্কুলের সিঁড়ির উপর। লাকড়িওয়ালার লাকড়ি ভারের ম্যাজ ম্যাজ ম্যাজ শব্দ শিরিষ দেবের বৃদ্ধ গোঙানির মত মনে হত। তন্ময় হয়ে চেয়ে থাকতাম শনপাতার দিকে।
শনের একটি পাতা আরেকটি পাতাকে ঘসলেও কাটত না। অথচ পাতার গায়ে কী ধার থাকত, মানুষের সাথে লাগলেই কেটে যেত। শোন বন্ধু, জীবনে সুগন্ধী ফুল হতে চাইনি। গন্ধহীন, অনুজ্জ্বল বুনো ফুলের মতই বড় হয়েছিলাম। ঝরার বাসনা ছিল না অকালে। যে ফুল গন্ধ ছড়ায় না তার কি টিকে থাকার অধিকার নেই ?
স্কুলের পশ্চিমের সীমানায় গলাগলি করে দাঁড়ানো ছিল কাঁঠাল গাছের সারি। গাছের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে পড়লেই লতি মেম্বারের বাড়ি। বাড়ির পাশ দিয়ে যে সরু রাস্তা গেছে তা কয় পা গিয়েই মিলেছে রেল লাইনের সঙ্গে। ঢাকা সিলেট রেলপথ। গ্রামীণ ফোনের জন্মের পর বাবা মোবাইল কিনলেন । নোকিয়া ৩৩১০। বাড়িতে নেটওয়ার্ক কাজ করত নিভু নিভু । রেললাইনের ওপরে উঠলে পুরো নেটওয়ার্ক পাওয়া যেত। এম সি কলেজ হোস্টেল থেকে বড়দা ফোন দিত।
ভাল
ছাত্র ছিল বড়দা। চশমা
পরা মেধাবী ছাত্র । পড়ত সারাক্ষণ
। বাবা বড় ছেলেকে
নিয়ে খুব আশা করতেন।
আত্মীয় স্বজন সবাই বড়দার উজ্জ্বল
ভবিষ্যতের বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন। আমি বড়দার ধারেকাছে
ছিলাম না কস্মিনকালেও। কেউ
আমাকে নিয়ে অতটা আশা করেনি।
কোন মতে বেঁচে বর্তে
থাকার মত একটা চাকরির
পাশ দিলেই হল। আমিও এমন
ভাবতাম। কি হবে এত
পড়া দিয়ে ? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ আমাকে পাল্টে দিল। আমি নিজেকে
নতুন করে চিনতে শুরু
করলাম।
বিরক্ত হচ্ছ বন্ধু। তুমার জানা গল্প তুমাকে শুনাচ্ছি । কি করব বল ? আমি তো আর মানুষ নই । গল্প শোনার লোক ওপারে নাই। সবার কাছে ঝুলিভরা গল্প। সুখের গল্প, অসুখের গল্প। কে শুনবে এত গল্প ? মানুষ হলে কুমড়া পাতা আর সিঁদল দিয়ে বানানো বড়া পাতে পেট পুরে বালাম চালের মোটা সিদ্ধ ভাত খেতাম। মজা সুপারি দিয়ে পান চিবাতাম। দুপুর বেলা আমড়া গাছের ছায়ায় গামছা বিছিয়ে ঘুম দিতাম | সুযোগ পেলেই লিলি সিনেমা হলে বাংলা সিনেমা দেখতাম | গাড়ি না পেয়ে রেল লাইন ধরে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। কুলাউড়া স্টেশন হতে ছকাপন। তারপর ফানাইপুল পাড়ি দিলেই বরমচাল । প্রিয় বরমচাল | আমার জন্ম ভিটা বরমচাল। কোদালিছড়ার বরমচাল ।
দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে। চল এবার উঠবে। যতদিন জীবন ততদিন খেতে হয়। কত রকমের খাবার। কালের গর্ভে যেদিন যাবে, যত্নে গড়া শরীর পঞ্চভূতের খাবার হয়েই যাবে। আগুন খাবে, পানি খাবে মাটি খাবে । আমি এত কথার লোক ছিলাম না। কথা শুনতেই পছন্দ করতাম। কিন্তু আমি এখন বাঁচতে চাই। তুমরা আমাকে ভুললেও আমি তুমাদের ভুলতে দিব না। আমার ছেলেকে দেখেছ। ও আমারই শাখা প্রশাখা। শেখর হাটছে, হাসছে, ঘুরছে ফিরছে নতুন শেখর হয়ে। তুমার জন্য চেয়ার রয়েছে। বস বন্ধু। এই চেয়ার আমার বড় প্রিয় ছিল। কাঁঠাল কাঠ দিয়ে বানিয়েছিলাম। কাঠ বার্নিশ করার পর অনুকূল মিস্ত্রীকে বলেছিলাম এত সুন্দর হইছে আমার বসতে ইচ্ছে হচ্ছে না, চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। আমার জায়গা এখন ঘরের দেয়ালে। ছবি হয়ে ঝুলছি নিত্যলালের তৈরি কাঠের ফ্রেমে।
খাওয়া শুরু কর। আমি তুমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকব। তুমার সময় নেই। কিন্তু আমার বলার শেষ নেই। যা পারি তাই বলি। এ বলায় মুক্তির আনন্দ বন্ধু। মাছের কাঁটার মত গলায় আটকে আছে না বলা গল্প গুলি। ফেলে আসা স্মৃতির খাতা দাড়ি কমা সহ চোখের সামনে ভাসছে। অথচ আমার শরীর নেই। চকলেটের বয়াম উপুত করলে একটা বাছাই করা যেমন কষ্টের। কার গল্প রেখে কার গল্প বাছাই করে বলব বুঝতে পারছি না বন্ধু।
মৃতের মন আছে। এটা সমাজে রটাতে পার। কারণ এই মুহূর্তে মন ছাড়া আর কী আছে বল ? মন আমার চনমন করছে। কতদিন পর আড্ডা হচ্ছে আমাকে নিয়ে। আমি থাকতে পারছি না। ক্ষণে বরমচাল, ক্ষণে সিলেট, কখনও নরসিংদী যাচ্ছি। বরমচালের প্রিয়তোষ শ্যামল, শাহিন,লুলু, ছানু, থুকু, নেতার, অজয়, রাহুল, চাবন কতজন টানছে। আমার কাছে আস। বন্ধ রাস্তার ওপারে আমি কিভাবে আসব বল ? আমি যাইনি। আছি। তুমাদের কাছাকাছি। তাও মানবে না। মেকি কান্নায় মা বলবেন, ফিরে আয় শেখর। ফিরে আসলে কেউ সাড়া দেবে না। বিদায় নেওয়া মানুষের ফিরে আসা মানায় না। মরা গাছের শরীরে গজানো কুঁড়িকে স্থান দেওয়ার জনাই তাকে মাটির সাথে মিশে যেতে হয়।
লালমিয়া বিল্ডিং এ চলে আসলাম একলাফে সোবহানীঘাট, সিলেট এ স্মৃতিময় বন্ধু ছাত্রাবাস। বাচ্চু আছে আজীবন বাসিন্দার পদে। আর পরিচিত কেউ নেই। কাননদা ফার্মেসিতেই কাটিয়ে দিলেন জীবন। পরের জন্য।
রঞ্জিতদা কাজলদা, বিভূদা, বাপ্পি, মিহিরদা, রূপকদা সবাই আমাকে অনেক ভালোবাসত। আমিও বাসতাম। বাতাসে মিশে আমার ভালোই হয়েছে। টুকটুকির মা যেদিন মেসে মুরগি রান্না রান্না করবে, আমি সেদিন চুপিচুপি ফিনিশ করে আসব দেশী মুরগীর রানের পিসগুলো। টুকটুকির ঢোলঢোলা পেট দেখে রঞ্জিতদা বলবেন, কিরে টুকটুকি তুই দেখি আজ ফুল চার্জ। উত্তমদা, থিয়েটারে কোন ভূতের রোল লাগলে বল। অরিজিনাল ভূত ফ্রিতে পেয়ে যাবে। বড় বিচিত্র ছেলে ছিল সুমিত। লাল মিঞার বিল্ডিং থেকে হেঁটে হেঁটে চলে যেত শাবি ক্যাম্পাসে। সকালে স্নান সেরে মাথায় আর পুরা শরীরে শরিষার তেল মেখে একটা দিস্তা খাতা বাণ্ডিল বানিয়ে স্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দে ছুট। বাসের সময় গুণে নাইওরপুল পয়েন্টে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা কোনদিন তার পোষাত না।
আরে কিছুইতো নিচ্ছ না। সব পড়ে আছে। নাও নাও, সব খেতে হবে। তুমি তৃপ্তি করে খেলেই আমার পরিবার ভাববে আমি তৃপ্ত হচ্ছি। বাংলাদেশে যে মানুষ খাবার অভাবে মারা যায়, তার মৃত্যুর পর কুলখানির অনুষ্ঠানে খাবারের অভাব হয় না। মৃতের পুত্র কন্যা ঋণ করে হলেও শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ঠিকমত করে। নিজের মুখে নিজের শ্রাদ্ধ ! এখন আর হাসতে পারি না। মুখ খোললেই আগুন আর আগুন।
১৩ ই জুন ২০২২ খ্রিঃ
বাগবাড়ি, সিলেট।
আরও পড়ুন: হাইনি
লেখকঃ পার্থ প্রতিম নাথ।