নিম খাওয়ালে চিনি বলে


টিভিতে বসে খবর দেখছিলাম, চুক্তিতে। যতটা সময় খবর দেখব ততটা সময় ছেলের সাথে তার ইচ্ছানুযায়ী খেলতে হবে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়য়া পুত্র পাশে বসে সময় গুনছে। খবরের শিরোনাম ছিল প্রতারণা শব্দ দিয়ে, শেষ ও হল প্রতারণা দিয়ে। মাঝখানের বিজ্ঞাপনটা প্রতারণার মধ্যে পড়ে কি না জানি না !
ছেলে জিজ্ঞেস করল বাবা, প্রতারণা কি ? আমি পাশ কেটে বললাম, চল খেলতে যাই। ছেলে নাছোড়বান্দা, আবার বলল, বল না বাবা, প্রতারণা কি ? আমি বললাম ওটা খারাপ শব্দ। বড় হও , তুমিই জেনে যাবে। মানলই না। বলতেই হল।
তুমিতো গান শুন। বল দেখি,“ নিম খাওয়ালে চিনি বলে, কথায় করে ছল। ওমা মিঠার লোভে, তিতো মুখে সারাদিনটা গেলো। খেলবি বলে, ফাঁকি দিয়ে ..........।”এটা কার গান। জানি না, ভুলে গেছি। এটা রামপ্রসাদের গান। পান্নালাল ভট্টাচার্যের গাওয়া এ গানটি আমার বড় মিঠা লাগে। ছেলে বলল বিরক্ত হয়ে, প্রতারণা কি বাবা ? আমি বললাম, বলছিইতো বাবা। তুমি বুঝতে পারছ না। না পারছিনা। সহজ করে বল প্রতারণা কি?
তুমি গতমাসে অসুখ পড়েছিলে না ? হ্যাঁ, তো কি হয়েছে ? এটাতো তুমি জান। আমিতো এখন সুস্থ। মা আমাকে অনেক ঔষধ খাইয়েছিল। আমি একথাই বলতে চাইছি বাবা। তুমিতো ঔষধ খেতে চাইতে না। কিভাবে খাব এগুলো ছিল বিশ্রিরকম তিতা। মনে হলে এখনও আমার বমি আসে।
তাহলে খেয়েছিলে কিভাবে ? মা আমাকে, মিষ্টি, মিষ্টি বলে খাইয়েছিল। এখন বুঝতে পারছ, রামপ্রসাদের গান আমি কেন গেয়েছি ? হ্যাঁ, এই যে তিতাকে মিষ্টি বলে খাওয়ানো, এটাই প্রতারণা। আর যে লোক এ কাজ করে তাকে বলে প্রতারক। হাততালি দিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল ছেলে। মা প্রতারক, মা প্রতারক। আমি  আর ঔষধ খাব না। মা তাকে ধমক দিল।
এই সুযোগে আমি পালাচ্ছিলাম। ছেলে আটকালো। খেলবে না বাবা ? না বা এখন না পরে খেলব। বাবার হাতে অনেক কাজ। তুমি ছবি আঁক। বাবা তুমি গতকাল ও  এরকম করেছ। আধাঘন্টা খবর দেখেছ, কিন্তু খেলনি। তুমি প্রতারণা করছ। আমি প্রতারক হয়েও পালালাম।। পাশের রুম থেকে পঞ্চম শ্রেণেিত পড়–য়া মেয়ে আওয়াজ দিল। বাবা তোমার চিটিং এর সংজ্ঞা হয়নি। আমরা বান্ধবীরা কাউকে কথা দিয়ে কথা না রাখলে, তাকে চিটিং বলি।
ভাবলাম হচ্ছেটা কি ? কেন সবাই প্রতারণার পেছনে এমনভাবে উঠেপড়ে লেগেছে ? এর কি অন্য প্রতিশব্দ নেই ? বাংলা একাডেমীর অভিধান হাতে নিলাম। প্রতারণায় বাংলা একাডেমীর তেমন আগ্রহ রয়েছে বলে মনে হল না। সাদমাটাভাবে লিখা রয়েছে প্রতারণা- প্রবঞ্চনা, শঠতা, ছলনা। আর প্রতারণা যে করে সে প্রতারক, প্রবঞ্চক শঠ, ধুর্ত খল, গোপনে অনিষ্টকারী।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত বঙ্গীয় শব্দকোষ অনুযায়ী শঠ- শক্তিগূহনকারী,মায়াবী “গীতা ১৮.২৮”। অন্য কথা, অন্য মন, বাহিরে অন্য আচরণ (চৈ.চ.৩৪২), কপটচিত্ত প্রভৃতি।
 
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাংলা শিক্ষকের সাথে আমার হালকা পরিচয় ছিল। বাংলা ভাষার উন্নতির জন্যে তিনি জীবন দিতে পারেন এমন জানতাম। হঠাৎ তার কথা খুব মনে পড়ল। কারণ অবশ্য আছে। একটু আগে ফেসবুকে তার আবেগঘন স্ট্যাটাস দেখেছি। না না বাংলা ভাষা নিযে নয়। গর্বিত পুত্রীকে নিয়ে। যে এবারের ’এ’ লেভেলে তাক লাগানো রেজাল্ট করেছে। শহরের নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে। প্রতারণা শব্দের ব্যাপ্তি কি এই বাংলা শিক্ষককে ছুঁতে পারবে ? নাকি শব্দটি শুধু ইতর শ্রেণীর লোকদের জন্যে ?
মিস্ত্রি মইয়ের সবগুলো সিঁড়ি ব্যবহার করে না। মাঝখান থেকে নিচের সিঁড়িগুলোকেই পা দিয়ে মাঢ়ায়। এটা কি প্রতারণা নয় ? ওপরের সিঁড়িগুলো সারা জীবন বসে বসে বাহবা নিয়ে গেল। তবু ভয়ে নিচের সিঁড়িগুলো মুখ খোলে না। নড়ে চড়ে বসলে, মিস্ত্রি আর শক্ত করে বাঁধবে যে। অথবা অকেজো হওয়ার আপরাধে খোলে ফেলে দিবে, উঠোনে। মিস্ত্রির বউ পরম আনন্দে জ্বালিয়ে দিবে চুলোয়।
কে প্রতারক নয় ? গীতিকার গান লিখেছেন,
“তোমরা যারা আজ আমাদের ভাবছ মানুষ কিনা ?
আমরা মানুষ, ভাগ্য শুধু করল প্রবঞ্চনা।
যার জন্যে কবি পথের ফকির তার নামটাও লিখতে পারছেন না। ভাগ্যের ওপর সব ছেড়ে দিচ্ছেন। এটা কি নিজের সাথে নিজের প্রতারণা নয় ?
এত বিশাল মহকাব্য লিখলেন ব্যাসদেব। ছলনা ছাড়া কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ করতেই পারলেন না মহাভারতে। ছল করেই কৃষ্ণের মাধ্যমে একে একে বধ করালেন সকল মহারথীকে। মৎস্যগন্ধার মৎস্যগন্ধ পরিত্যাগের লোভ দিয়ে মহাভারত শুরু করলেন ব্যাসদেব। লোভে লাভ হল সত্যবতীর। রাজরাণী হলেন। পুরো মহাভারতই যেন ছল ও প্রতারণার ইতিহাস। ধর্ম তার মোঢ়ক মাত্র।
আরেক মহাকবি বাল্মিকীও রামায়ণ শেষ করতে পারেননি সরল রেখায়। মহাবলী বালীকে ছল করে মারতে হয়েছে। রামচরিত্র এজন্যে কলঙ্কিত হযেছে। সুগ্রীবের রাজ্যলাভের লোভ এখানে লাভে পরিণত হয়েছে। পাঠকের কাছে ধরা পড়ায় হাজার হাজার বছর পরেও উচ্চারিত হচ্ছে সুগ্রীবের লাভ, রামচন্দ্রের পাপ।
সবচেয়ে বড় নাস্তিক কাশ্যপ মুণি, অবশেষে ভগবান বুদ্ধ। লেভেল সর্বোচ্চতে পৌঁছাতে পারলে ভগবানই ভূত, ভূতই ভগবান। শয়তানের প্ররোচনা বা প্রতারণাতেই আদম জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়েছিলেন। প্রতারণার খবর দিয়েই আদম জীবন যেখানে শুরু সেখানে আজকের ঘটনাগুলোকে নতুন বলা যায না। শাহেদ, সাবরিনা, আমি ,আপনি সবার বিরুদ্ধেই যখন প্রতারণার অভিযোগ আসবে, তখন বিচার করবে কে ? নাসিরুদ্দীন মোল্লার গল্পটা পড়েই বুঝে নিন।
“ নাসিরুদ্দীন গ্রামের মোড়ল হয়েছেন। বিচারের দায়-দায়িত্ব তিনিই পালন করেন। একবার এক বিদেশি লোক এসে মোল্লার নিকট বিচার দিয়ে বলল,‘মোল্লা সাহেব এই গ্রামের কিছু লোক আমার টাকাপয়সা, এমনকি পোষাক পর্যন্ত খোলে নিয়েছে ! আপনি এর একটা বিহিত করুন।’
একদিকে বিদেশি লোকের অভিযোগ অন্যদিকে নিজের গ্রামবাসী- মোল্লা ভারী মুশকিলে পড়লেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনি মিথ্যা বলছেন। লোকটি অবাক হয়ে বলল,‘ এ কীরকম কথা ! আমি মিথ্যা বলছি ?’
মোল্লা এবার গুরুগম্ভীর হয়ে বললেন‘আলবত মিথ্যা বলছেন। এ গাঁয়ের লোককে আমি জানি, ওরা সব নিলে আপনার গায়ের গেঞ্জিটা পর্যন্ত নিয়ে যেত, কিন্তু তাতো নেয়নি। অতএব আপনি মিথ্যে বলছেন।’ মোল্লার কথা শুনে লোকটি একেবারে বোবা হয়ে গেল।”

ইদানিং খবর দেখে, শুনে আমরাও বোবা হ্ই। তবে যতক্ষণ অন্য খবর আমাদের মাথার ওপর চড়াও না হয়, ততক্ষণ নিজেই নিজের শ্রাদ্ধ করি।


আরও পড়ি: হাইনি

লেখক : পার্থ প্রতিম নাথ।

 

 

 

parthiv

parthiv Means Earth Related. We Want To Learn Life Of Earth.

Post a Comment

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال