বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল। অনেক মানুষের প্রিয় ফল। তবে কাঁঠাল অনেক কিছুতেই ভূমিকা পালন করে। প্রেম আর কাঁঠালের আঠা বাঙালির অপার্থীব সম্পদ। কিন্তু এবার সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জের কাঁঠাল শিক্ষা দিল আধিপত্য বিস্তারের।
আধিপত্য বিস্তারের স্বভাব মানুষের জন্মগত। প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। জন্মের পর শিশু তার মায়ের দুধের একটি পান করে অন্যটি হাত দিয়ে ধরে রাখে । মায়ের ভালোবাসার ওপর শিশু নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। ভাই বোনদের সংখ্যা বেশি হলে সবচেয়ে কনিষ্ঠ সন্তান মায়ের কোল দখলে রাখে। যাতে অন্য কেউ বসতে না পারে। মা ভুল করে বড় সন্তানকে একবার চুমু খেলে অবুঝ ছোট সন্তান তা দেখে ক্ষুব্ধ হয় এবং দশবার চুমু খেতে চায়। একইভাবে সবকিছুতেই সুস্থ মানুষ আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। আর এই আধিপত্য বিস্তারের খেলা মায়ের কোল হতে কবর পর্যন্ত ঘটতে থাকে। সুস্থ মানুষ ক্রমশই আধিপত্য বিস্তারের খেলায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। আধিপত্য বিস্তার এক সময় স্বাভাবিক হতে অস্বাভাবিক বিষয়ে চলে যায়। তখনই ঘটে দুর্ঘটনা। আধিপত্য বিস্তারের বিষয়কে মানুষ সামনে নিয়ে এলে সেটা হয়ে দাঁড়ায় একটা অপরাধ। সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জের হাসনাবাদ গ্রামে যে কাঁঠাল কান্ড ঘটে গেল তাই এই আধিপত্যবাদের ফসল। একই গোষ্ঠীর দুই দল মানুষ নিজেদের ফাউ প্রেস্টিজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু চরম বাস্তব কথা, আধিপত্য বিস্তারের সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে এটি। মসজিদের দান করা কাঁঠালের দাম নিলাম করা নিয়ে চার চার জন মানুষের প্রাণহানি দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে খারাপ খবর হিসেবে ভাইরাল হয়েছে। অনেকে একে হিন্দি সিনেমা Kathal: A Jackfruit Mystery এর চেয়ে নাটকীয় বলেছেন ।
আধিপত্য বিস্তার আমাদের রক্তে মেশানো। কেউ দেখিয়ে করি আর কেউ না দেখিয়ে।কেউ খুন করে, রক্তে গঙ্গা বয়ে যায় আর কেউ নিরবে ছুরি মারে অথচ মুখের হাসি দিয়ে তা সমাজে দৃশ্যমান হতে দেয় না। সুনামগঞ্জের এই মারামারি এবং হত্যাকাণ্ডের খবর প্রথম যখন চাউর হয় সব দোষ গিয়ে পড়েছিল কাঁঠালের ওপর। মানুষ মরুক তাতে আপত্তি নাই, তবে কাঁঠালের জন্য মরবে, তা মেনে নেয়া যায় না। মানুষের প্রতিক্রিয়া ছিল এরকমই। গীতিকার যেমন গান লিখেন একটি গন্দমের ও লাগিয়া ----।
কাঁঠালের বদনাম গুছিয়ে আস্তে আস্তে খবর বেরিয়ে আসে শান্তিগঞ্জের হাসনাবাদ গ্রামের একই গোষ্টির দুই গ্রুপের পঞ্চাশ বছর ধরে আসা আধিপত্যের লড়াই । কে বড়? তুই না আমি ?
এই আধিপত্য বিস্তারের লড়াই কোন গ্রামে নাই ? কোন স্থানে নাই ? কোন সেক্টরে নাই? পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কৃতি অর্থনীতি, ক্ষেতের মাঠ, মসজিদ,মন্দির প্রাইমারি স্কুল থেকে সচিবালয় সর্বত্রই আধিপত্য বিস্তারের লড়াই । এ লড়াইয়ে অপেক্ষাকৃত অশিক্ষিতরা মরে কাঁঠাল কাণ্ডের মত ঘটনায়। আর উচ্চশিক্ষিতরা আধিপত্য বিস্তার করে তুলনামূলক কম নোংরা উপায়ে। আন্তর্জাতিক আধিপত্য বিস্তারের নমুনা তো আমাদের সামনেই, রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধ।
সমাজবিজ্ঞানের কোন অংশে এই আধিপত্যবাদ নিয়ে আলাপ করলে ভালো হবে তা জানা দরকার। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে বা পাঠ্য বইয়ে আধিপত্যবাদ পড়েছি তবে তা ঐতিহাসিক রাষ্ট্র দখল আর সাম্রাজ্যবাদ। আর আধুনিক চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে পারমানবিক অস্ত্র, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তেলের রাজনীতি, অস্ত্রের রাজনীতি এগুলো আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু আমাদের এই ছোট্ট বিষয় কোথায় পাব? যেখানে এক কাঁঠালে চারজন মরে চল্লিশ জন আহত হয়। পুরো গ্রামের মানুষকে পালিয়ে বেড়াতে হয় শিশুরা কাঁদে। কারণে-অকারণে আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করা যে অন্যায়, অপরাধ এটা স্কুলে বা কলেজে বিদ্যার্থীদের শেখানো উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে, সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন প্রকারের আধিপত্যবাদ নিয়ে গবেষণা করা উচিত। কারণ মানুষ আধিপত্য বিস্তারে এখন নৃশংস হয়ে উঠেছে। বিচার মানছে না। সালিশে বসে বিচারকের সামনে খুন করছে প্রতিপক্ষকে। তাই মহামারী আরো প্রকট হওয়ার আগেই তার প্রতিষেধক আবিষ্কার করা আবশ্যক। জানি এ ব্যাপারে কেউ এগিয়ে আসবেন না। কারণ এখানে করোনার ভ্যাকসিন বেঁচে টাকা কামানোর মত বড় প্রজেক্ট নাই। এই মহামারির ভ্যাকসিনে কারো আগ্রহ থাকবে না। থাকবে না এই সামাজিক মহামারি নিয়ে। শুধুই উহু আহা তে আটকে যাবেন সুশীল বুদ্ধিজীবিরা ।
অথচ একবার ভাবুন তো ঘুম থেকে ওঠে যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তা আধিপত্যবাদ কিনা? অথবা আপনি যে কারণে ঘুমাতে পারছেন না সেটা অন্যের আধিপত্যবাদ এর প্রভাব কিনা ? আপনার ওপর সেটা বিভিন্ন প্রকারে আসতে পারে। সম্পত্তির ওপর হতে পারে, পেশার ওপর হতে পারে, পদের ওপর হতে পারে, খ্যাতির ওপর হতে পারে। সবার ওপরে সবাই। ওপরে থাকতে চায়, তবে সৃষ্টিতে নয় ,ক্ষমতায় । আমরাও আমাদের শিশুকে বড় হতে শেখাই। তবে দখল বা ক্ষমতার পরিবর্তে তাদের সৃষ্টিশীলতায় শ্রেষ্ঠ হতে হবে তা আর বলে দেই না। তাই আজকের শিশু আগামী দিনের সৃষ্টিশীল ব্যক্তি হওয়ার পরিবর্তে আধিপত্য বিস্তারকারী একজন দখলদারের পরিণত হয়। স্কুলে গিয়ে তারই শিক্ষককে অপমান করে কমিটির সভাপতি হতে চায়। অফিসে গিয়ে বসকে অপদস্ত করে কাজটা ভাগিয়ে নিতে চায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও অধ্যয়নের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দাদাগিরিতে। রাজনীতিতে আর কোন কিছু বলার তো সুযোগ নেই। পুরোটাই, জোর যার দখল তার।
আমাদের নীতিকথা সম্বলিত মজার গল্পগুলো বিশেষ করে বন জঙ্গল সম্পর্কিত মজার গল্পগুলো এইরকমই। সবাই বনের রাজা হতে চায়। বাঘ সিংহতো হয়ে থাকে, এমনকি চামচিকাও শেষ পর্যন্ত রাজা হতে চায়। আধিপত্য বিস্তারের ক্ষুধা ভয়ংকর। কার মাথায় কে কাঁঠাল ভেঙে খায় খোদা জানেন।
আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় যে যা পারে তাই নিয়ে লড়াইয়ের সামিল হয়। আন্তর্জাতিকভাবে যদি ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইকে বলা হয় কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে গ্রামে গঞ্জে পরিস্থিতি শীতল থাকে খুব কম। অঞ্চল বেঁধে একটু আগে পরে গরম হয়ে পড়ে মাঠ। একদল ঝাঁপিয়ে পড়ে আরেক দলের উপর। কয়েক জন না মরা পর্যন্ত ওরা থামে না।
আধিপত্যবাদের লড়াইয়ে নিরীহ লোকটিও কিন্তু কম যায় না। সে তার অসহায়ত্বকে কাজে লাগায় তার গায়ে স্পর্শ লাগার আগেই সে চিৎকার দিয়ে পাড়া মাথায় তোলে। মানবতার ফেরিওয়ালারা জাতিসংঘের লেবাসে তখন ফেরেশতা হয়ে ঘুরে কিভাবে বিচার করবে। কিভাবে বিচারক হবে। কিভাবে সে তার আধিপত্য বিস্তার করবে। মানবতার ধ্বজা উড়িয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায় শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো। শক্তিশালী পরিবার গুলো শক্তিশালী সমাজ ব্যবস্থায় আধিপত্য দেখাতে মরিয়া। এটাই হয়ে আসছে যেমনটি আমাদের মত দেশের ক্ষেত্রে আমেরিকা বা চীন করে থাকে। তাদের অধীনতা স্বীকার করলে তুমি খুন কর সমস্যা নাই। মানবতা রক্ষায় তাহা হালাল । জাতীয় পরিমণ্ডলেও অবস্থা একই। ভাইয়ের কথা মানলে অর্থাৎ অধীনতা স্বীকার করলে তুমি চুরি করেও মানবতার ফেরিওয়ালা। আর ভাইকে অস্বীকার করলে তুমি ধর্ম-পুত্র যুধিষ্ঠির হয়েও লাভ নেই । মহাভারতের যুধিষ্ঠির স্বর্গে গেলেও কলিকালের যুধিষ্ঠির নরকের টিকিট পাবেন না। বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরবেন। বিচার পাওয়া তো দূরের কথা এ বিচার কোনদিন শুরুই হবে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে বেড়েই চলেছে। তাই মানুষ হয়ে উঠেছে অসহিষ্ণু। মানুষ আর যুক্তির ধার ধারে না। ডাইরেক্ট একশানে বিশ্বাস করে। তাই কথা কাটে না। মাথা কাটে। মাথা না থাকলে আর কথা হবে কি দিয়ে ? মানুষের অহমিকা আর নৃশংসতা তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবিকতা তাই হাসনাবাদে হাস্যকর দুর্বল শব্দ। কাঁঠাল কান্ড তাই বলে।
আরও পড়ুন: কুতুব
লেখক: পার্থ প্রতিম নাথ।