স্বরূপের সংকট না নব্য সাম্প্রদায়িকতা

 

স্বরূপের সংকট না নব্য সাম্প্রদায়িকতা

আমাদের পাড়ায় যে পাগলী বাস করে তাকে দেখে পুরা পাগল মনে হয় না। তবুও তার পরিচিতি সে পাগল। আজ সকালে দুর্গা মন্দিরের লাগোয়া মূল চলাচলের রাস্তায় বসে সে প্রস্রাব করছিল। সকাল তখন নটা। স্কুল অফিসগামী মানুষের সংখ্যা একেবারেই কম নয়। এলাকার মুরুব্বী স্থানীয় একজন মানুষ তাকে বাঁধা দিলেন। যদিও সে কাজ ইতিমধ্যে সেরে ফেলেছে। তবুও তিনি তার উদ্দেশ্যে বলছিলেন , এই কাজটা তুই কি করলি ? এতেই পাগলীর প্রেস্টিজে লাগলো। হিন্দু মুরব্বিকে সে চিনে। পাগলদের এই একটি বৈশিষ্ট্য সে যে জায়গায় থাকে সেখানে  সব চেনে জানে কিন্তু না চেনার ভান করে পাগলি মুরব্বিকে চোখ রাঙিয়ে বলছিল ,তোমারে কইলাম আর কথা বাড়াইও না। চইলা যাও। তুমি ইন্দু মানুষ, বালা হইবো, চইলা যাও। চইলা যা মালাউনের বাচ্চা

রাস্তায় হাঁটছি আর ভাবছি পাগলীর কথা। আর গোলাম মুরশিদের প্রবন্ধ, স্বরূপের সংকট ,না নব্য সাম্প্রদায়িকতার কথা। বাংলাদেশের পঁচিশ বছর পূর্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সেমিনারে প্রথম দিন পঠিত প্রবন্ধের উপর ভিত্তি করে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে লেখা তার এই প্রবন্ধ। বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতেও  প্রবন্ধের  প্রতিটি শব্দ একেবারে তাজা কারণ লেখকের গবেষণা এবং প্রবন্ধে ব্যক্ত করা অনুমান প্রমাণিত হয়েছে দারুণ ভাবে। প্রবন্ধটি এত সমৃদ্ধ যে প্রতিটি বাক্যের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে নিরপেক্ষ সত্যের লিপি। কোন আবেগ বা পক্ষপাতিত্ব লেশমাত্র নেই। এই প্রবন্ধ বাংলাদেশের জন্মের বহু পূর্ব থেকে বাঙ্গালীদের বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের স্বরূপের সংকট নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন গোলাম মুর্শিদ। পুরো প্রবন্ধ পাঠ করলে একটি কথাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভাষা,অঞ্চল,সংস্কৃতি সব ছাপিয়ে একমাত্র ধর্মই হয়েছে বাঙালি মুসলমানদের স্বরূপ অথচ এক সময় ভাষার জন্য মুসলমান বাঙালি প্রাণ দিয়েছে। হিন্দুকে রক্ষার জন্য মুসলমান সম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু ঘুরে ফিরে ওই একই ভূত চেপে বসে আজ পাগলীর কথা গোলাম মুর্শিদের প্রবন্ধে হুবহু ওঠে এসেছে।গোলাম মুর্শিদ লিখেছেন ,এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা দেখে আত্মপরিচয়ের গুরুতর কোন রূপান্তর দেখা যায়নি যদি কোন রূপান্তর ঘটে থাকে তাহলে বলতে হয় সেই পরিচয় আরো মাগরেবী চেহারার নিয়েছে। এখন বাংলাদেশ প্রায় সার্বজনীকভাবে ইসলামী দেশ বলে পরিচিত। বাংলাদেশে বসবাসকারী অমুসলমানও জানেন যে তারা দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এমনকি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও জানে যে একজন হিন্দুকে হিন্দু বলে ধমকানো যায় দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া যায় এমনকি তাদের উপর হামলা চালিয়ে অথবা তাদের বাড়ির যুবতীকে ধর্ষণ করে যত সহজে পার পাওয়া যায় একজন মুসলমানের ওপর একই ধরনের হামলা চালিয়ে তা পাওয়া যায় না।

এটাই চরম সত্য পঞ্চাশ বছর পরও বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট ছাত্র মনে করে তার প্রথম পরিচয় সে মুসলিম। এখনো যে স্কুলে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান বৌদ্ধ সকল শ্রেণীর ধর্মের ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করে সেই স্কুলের অনুষ্ঠানে গরুর মাংসের বিরিয়ানি হয়। এখনো যে সকল অফিসে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ কাজ করে শুধু সংখ্যা গরিষ্ঠতার শক্তিতে সংখ্যালঘুকে অবদমিত করার উদ্দেশ্যে তাকে হেনস্ত করা হয় ।{alertSuccess}

গোলাম মুর্শিদ লিখেন ,
অদৃষ্টের পরিহাস, যে বাঙালিয়ানা আসার ফলে বাংলাদেশ সৃষ্টি হলো, সেই বাঙালিয়ানায় ভাটা দেখা দিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। প্রশ্ন করা সঙ্গত, মোহভঙ্গ হতে কাদের সময় কম লেগেছিল? - পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের, নাকি বাংলাদেশের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালিদের? আমার ধারণা, বাঙালিদের। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসেই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিব ধর্ম এবং ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে যে সংকেত দেখান, তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে কোনোদিন ধর্মনিরপেক্ষ হবে না। তার পরিচয় ইসলামী না হলেও সে হবে একটি মুসলিম রাষ্ট্র, যেখানে অমুসলমানরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক না হলেও, থাকবেন সংখ্যালঘু হিসেবে। তা সত্ত্বেও, ধর্মনিরপেক্ষতা যে বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মৌলনীতির অন্যতম বলে স্বীকৃতি লাভ করে, সেটাই বিস্ময়ের কারণ। বস্তুত এটা ছিল দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এবং অমুসলমানদের প্রতি একটা বড় ছাড় দেবার ঘটনা। এই অমুসলমানরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, হয়তো তা তখনো ভুলে যাওয়া অত সহজ ছিল না। পাকিস্তানি ফৌজি বাহিনী এবং তাঁদের দালালদের পাশবিক নির্যাতন থেকে কেউই প্রায় রেহাই পায়নি, কিন্তু এই অত্যাচারের প্রধান শিকার হয়েছিলেন অমুসলমানরা
তবে চূড়ান্ত আঘাত আসে অন্য পথে মুজিবুর রহমান কেবল জাতির জনক ছিলেন না নেতা হিসাবে ছিলেন অসাধারণ প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয়। কিন্তু তিনি যখন ফৌজি বাহিনীর বিদ্রোহী কিছু কর্মকর্তার হাতে নিহত হন তখন ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে ধর্মীয় পরিচয় দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়

গোলাম মুর্শিদ তার প্রবন্ধে আঙ্গুল ধরে ধরে দেখিয়ে দিয়েছেন জাতির পিতা শেখ মুজিব নিজেকে মুসলমান হিসেবে দাবি করতেন কিন্তু মুসলমান ধর্মকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতেন না। জিয়াউর রহমান কিংবা জেনারেল এরশাদ মুজিবুর রহমানের চাইতে মোটেও বেশি ধার্মিক ছিলেন না। কিন্তু ইসলাম ধর্মকে ক্ষমতার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন সব সময়। সংখ্যালঘু নিধনকে উৎসাহিত করেছে জেনারেল এরশাদ ১৯৮৮ সালে সংবিধানকে সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষণা করে

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার মাত্র ১৭ বছরের মধ্যে কিভাবে তার আত্মপরিচয় সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ যার জন্য ১৯৭১ সালে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানরা মুসলমানদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন। সে বাংলাদেশ এখন পাওয়া যাবে কেবল ইতিহাসের পাতায়। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আবার ধর্মনিরপেক্ষ হবে এমন সম্ভাবনাও খুব কম। গোলাম মুর্শিদের আশঙ্কা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দূর করেছে একথা জোর গলায় বলার অবকাশ নেই বরঞ্চ আওয়ামী লীগের লেবাসে ধর্ম ব্যবসায়ী প্রবঞ্চকেরা শক্তিশালী হচ্ছে দিন দিন। যার প্রতিফলন ঘাটে হাটে মাঠে অফিস আদালতে এমন এমন কি রাস্তার পাগলীর মুখে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বাংলাদেশের এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ,সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে অথবা রাজনীতিবিজ্ঞানের পাঠে এই পঞ্চাশ বছরে কোন ফলপ্রসূ গবেষণা হয়েছে কি ?কেন আমরা স্বরূপের সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলাম না ? কেন সাম্প্রদায়িকতা শুধু নব্য নব্য রূপ পেল আমাদের বাংলাদেশে ?

আমার পরিচিত এক শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের বর্তমান দূরাবস্থার কথা বলে লেখাটির ইতি টানব। হাজি সাব বলেই সবাই চিনত তাকে। সরকারের ভাল দপ্তরে চাকরী করতেন বলে জানতাম। এক ছেলে এক মেয়ের সুন্দর সংসার হাজি দম্পতির। ছেলেটি মেধাবী, পরহেজগার এবং সংস্কৃতিমনা। ভালো গিটার বাজায় গান করে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ভালো রেজাল্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সময়ে ঘটে গেল দুর্ঘটনা। এক দিন বাসায় পুলিশ এল। ধরে নিয়ে গেল ছেলেকে। কেউ ঘুণাক্ষরে টের পায়নি ছেলে জিহাদে অংশ নিতে আফগানিস্তান যাচ্ছে।
আজ পেনশনার হাজি সাব পেনশনের সকল টাকা ঢেলে দিয়েছেন ছেলের মুক্তির পেছনে। কিন্ত জামিন হচ্ছে না। তাই বৃদ্ধ বয়সে কারাগার আর কোর্টেই কাটছে সময়। অবাক হলাম ছেলের কারণে বাবা নিজের কোন দোষ দেখতে পাচ্ছেন না। ধর্ম আর গান বহিরাবরণ। অন্তরের স্বরূপের ঠিকানা দেবে পরিবার। মানুষ হিসেবে পরিচয় করাতে হবে সন্তানকে। তারপর বাঙালি আর আরবি। সুন্নি আর কাদেরী। হিন্দু আর মুসলমান। মানুষ হলেই সে অন্যের ধর্মে আঘাত দেবে না। নিজের ধর্মকেও সমৃদ্ধ করবে। দূর হবে স্বরূপের সংকট। সৃষ্টির পথ রুদ্ধ হবে নব্য সাম্প্রদায়িকতাবাদের।

 আরোও পড়ুন: কুতুব

 পার্থ প্রতিম নাথ

parthiv

parthiv Means Earth Related. We Want To Learn Life Of Earth.

Post a Comment

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال