কৃষ্ণপুরে সিদ্দিকী হত্যা

কৃষ্ণপুরে সিদ্দিকী হত্যা
সিদ্দিকী সাহেবকে হত্যা করা হয়েছে গত শনিবারে। আগামীকাল আরেক শনিবার। আজ দোসরা জুন দুই হাজার তেইশ খ্রিষ্টাব্দ। আমার সামনে স্থির করা টেবিলে কত কাজ। বাঁদিকে কম্পিউটারটা হা করে চেয়ে আছে, তাকে টিপছি না কেন ? এতসব ব্যবস্ততার মাঝে মনে হয় সিদ্দিকী সাহেবের লাশটা এক সপ্তাহ ধরে পড়ে আছে আমার টেবিলের উপরে। মাথা ভার হয়ে আসে। খুন আর জখমে জীবন। জন্মিতে মায়ের খুন ঝরে। বাঁচতে ঘাম হয়ে খুন ঝরে আর প্রতি পদে পদে জখম হতে হতে মৃত্যুতে হয় জীবন পূর্ণ। মৃত্যু স্বাভাবিক  হতে পারে অথবা অপমৃত্যু। মরতে যে হবে। জন্ম-মৃত্যু-হত্যা স্বাভাবিক! তবুও সিদ্দিকী সাহেবের মৃত্যু বা হত্যা আমাকে টানে। কেন ?

শোনা খবর আর দেখা খবর এক নয়। রাশিয়া-ইউক্রেনের খবর আর বাংলাদেশ-ভারতের খবর এক নয়। নিজের বাড়ি আর পাশের বাড়ির খবর আপনাকে যতটা ভাবায় দূর-দূরান্তের খবর আপনাকে ততটাকে ভাবায় না। আমার জন্মভিটা বরমচালের পাশের ইউনিয়নের খবর তাই বেশি ভাবছি আমি। বার বার মনে হচ্ছে পেনশনে যাবার পর আমাকেও কী এভাবে মরতে হবে ? পেনশনে যাবার পর আমার প্রাপ্ত অর্থ লুট করতে আমার স্বজনেরা দুর্বৃত্ত হয়ে খুন করবে না তো আমাকে? পেনশন কিংবা যেকোন সম্পদ লুট করতে আপনজনেরা যে আমাকে খুন করবে না তার নিশ্চয়তা কী ?

সিদ্দিকী  হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল এভাবে- মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় শেখ রফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী(৬৫) নামে সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। শনিবার ভোর রাতে উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে নিজ বাড়ি থেকে রফিকুল ইসলাম সিদ্দিকীর লাশ উদ্ধার করা হয়। এদিকে রফিকুল ইসলামের বড় ভাই শেখ সিরাজুল ইসলাম সিদ্দিকীর দাবি তার ভাইয়ের স্ত্রী এবং কন্যারা অবসর ভাতার টাকা ও পারিবারিক বিরোধের জেরে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে তার ভাইকে। পুলিশ রফিকুলের মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত স্ত্রী, কন্যা ও জামাতাসহ চার জনকে গ্রেফতার করেছে।

খবর শোনলে, খবরের ভেতরের খবর জানার আগ্রহ জাগে। জানা গেল মৃত সিদ্দিকী সাহেবের স্ত্রী মিছফা আক্তার সিদ্দিকা। বয়স পঞ্চান্ন। জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ শারমিন আক্তার সিদ্দিকা। বয়স পঁয়ত্রিশ। স্ত্রীর নামের সিদ্দিকা দেখে অবাক হলাম না। বিয়ের পর দেশে বিদেশে অনেকেই স্বামীর পদবী লকেটে ঝোলান। আনন্দে আহ্লাদিত স্বামী হীরার হার কিনে দেন স্ত্রীকে। সেই হার আবার কখনো স্ত্রীর গলায় ফাঁস হয়, কখনো স্ত্রী ফাঁস দিয়ে মারেন স্বামীকে।

মেয়ে শারমিন আর তার বাবার বয়সের বিশ্লেষণে অনুমান করা যায় সিদ্দিকী সাহেব প্রায় চল্লিশ বছর ধরে সংসার করছেন। আমরা বিবাহিত জীবনকে সংসার হিসেবে মানি। সিদ্দিকী সাহেবের ভাইয়েরা বলছেন তাদের সহজ সরল ভাই বউয়ের কারণে সারাজীবন জ্বলে পুড়ে মরেছেন। ভাই আমাদের , তার ঘরে ভাত পেত না। বউ ভাত দিত না। গ্রামের বিভিন্ন জনের বাড়িতে গিয়ে ভাত চেয়ে খেত। হজ করতে গিয়েও আল্লার ঘরে বসে বউ, আমার ভাইকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে । আমরা ভাই হত্যার বিচার চাই।

হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত স্ত্রী কন্যা বলছে, বাবা আমাদের মানসিক রোগী ছিল। বিনা কারণে আমাদের মারধর করত। আমার মা, আমরা বোনেরা পাগল বাবার জন্যে একদিনও শান্তি পাইনি।

জীবনটাকে মঞ্চনাটক ভাবলে, দেখুন এই মুহূর্তে আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তার চতুর্পাশে কত ছবি । সবাই স্থির, আপনি ছবি তোলেন। বাবার হাত ধরে সন্তান স্কুলে যাচ্ছে। মোটর সাইকেলের পিছনে স্ত্রীকে নিয়ে স্বামী যাচ্ছেন অফিসে। গত রাতে অথবা সকালে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল তার ছিটেফোঁটাও নেই ছবিতে। ব্যাংকার যাচ্ছেন ব্যাংকে হাতে হটপট। রিক্সা পোলার ডাকছে যাত্রীকে। সিএনজি ট্যাক্সিওয়ালা হাঁক দিচ্ছে  আম্বরখানা ,দরগা গেট, আম্বরখানা, বরখানা….বরখানা। মহিলা কলেজে ঢুকছে ছাত্রী। আলপাইন হোটেলে গ্রীল হচ্ছে মুরগী। পোড়া মবিলের মত চকচক করছে তৈলাক্ত মুরগী। প্রত্যেকটি ছবি এক একটি প্লট। মৃত সিদ্দিকী সাহেবের জীবনে এ রকম প্লট কী ছিল না? যৌবনে বিবাহ। নতুন বউয়ের স্পর্শ তাকে কী একবারও আনন্দ দেয়নি। তার স্ত্রী কি একদিনের জন্যেও স্বামী সোহাগী হন নি? পাঁচ ছয়টা সন্তান উৎপাদন দু’জনের চেষ্টা ছাড়া কিভাবে সম্ভব হয়েছে ? সন্তানদের জন্মক্ষণ কী এরা মনে রাখেননি। হ্যাঁ অনেক বাবা সন্তানের জন্ম মনে রাখতে পারে না,কারণ মায়ের মত প্রসব যন্ত্রণা তাকে ভোগতে হয় না। তবে যে মেয়েটা বলছে তার বাবা পাগল, সেকি কোনদিন একটুকু  পিতৃস্নেহ পায়নি?  অবশ্যই পেয়েছে। তবে অল্প অল্প করে জমা হওয়া বঞ্চনা একদিন বৃক্ষ হয়ে ঘরের ছাদ ভেদ করবে তা কেউ ভাবতে পারেননি। নষ্ট হওয়া সম্পর্ক গ্যারেজ ওয়ার্কশপে যাওয়ার আগে ঘরে মেরামত করে নিলে আজকের এ দিনটির মত দিন কৃষ্ণপুরে উদয় হত না। আমাদের সমাজ নামক ওয়ার্কশপে ভালো মিস্ত্রির বড় অভাব । সব হাতুড়ে আর ভণ্ড দখলে নিয়েছে সম্প্রীতির সমাজ। সালিশ –বালিশ সব ভেস্তে যায় শক্তিমান রিপু ঈর্ষার কাছে। সালিশে বসেই খুন হন কত ব্যক্তি। কেউ আর বাঁচাতে পারে না কাউকে।

বাঙালি স্বামী-স্ত্রী কোনকালে একপক্ষ হতে পারে নি। এরা পৃথিবীর অন্যান্য জাতির কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আলাদা হতেও শিখেনি। সংসার ভেঙ্গে গেলে স্বামী-স্ত্রী দু’জনই রিজেক্টেড মাল। সমাজে, বিয়ের বাজারে এদের আর কদর থাকে না। কোন কোন সমাজে আর বিয়েরই সুযোগ থাকে না। আর ভেঙ্গে যাওয়া পরিবারের সন্তান সন্ততির জীবনে গ্রহণ লেগেই যায়। নাসা, এ্যাপলের মত প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে এমন পাত্র অথবা পাত্রী যদি বাঙালি হয় আর তার পরিবার যদি বাবা-মা বিচ্ছেদে টুটা পরিবার হয়, তবুও সম্বন্ধ করার আগে বাঙালি একবার  ভাববে। এই হল বাঙালি সমাজ। একচোখা দৈত্য। এই সমাজ রূপী দানবের ভয়ে কত জীবন জ্বলছে।

সিদ্দিকী সাহেব তার স্ত্রীর কাছ থেকে আলাদা হতে পারতেন । তার স্ত্রীও তাকে পরিত্যাগ করতে পারতেন। কিন্তু কেউ পারেননি কারণ তারা আম জনতা। তারা পরিমণি বা নায়ক শরিফুল রাজ নন। তারা চাইলেই কিছু করতে পারেন না। তাদের বিচ্ছেদের খবরে সমাজের লোক আমোদ পেত না। রক্তচক্ষু নিয়ে শাসাত। সমাজের চাপে ঝড়ের সাথে উড়ে যাওয়া খড়-কুটোর মত উড়ে যেত। তাই এত সমস্যা সত্বেও এরা সন্তানের জন্ম থেকে বিয়ে পর্য্যন্ত দিয়েছেন। কিন্তু আর পারেননি। মরণব্যাধি ঈর্ষা তার চরম রূপ দেখিয়েছে।

কৃষ্ণপুরের ঘটনা বাংলাদেশ তথা বাঙালি সমাজে অহরহ ঘটছে। কেউ এ সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তির রাস্তা খোঁজেনি কখনো। সবাই পালাতে চেয়েছে। ভেবেছে আর যাই আমার বেলায় ঘটবে না এরূপ। বাঙালি সমাজ এখনো হুজুগে সমাজ। নতুন ইস্যু নতুন গল্প ছাড়া এরা চা পর্য্যন্ত খেতে পারে না। কদিনের মধ্যেই সিদ্দিকী সাহেবের ঘটনা পুরানো হয়ে যাবে সবার কাছে। পুলিশ, উকিল-আদালত মিলে গিলে খাবে তাদের পুরো সহায় সম্পদ। পত্রিকা বাসি খবর ছাপে না। তাদের পেট পিট আছে। এক সিদ্দিকী সাহেবের পিছনে পড়ে থাকলে চলবে ? পত্রিকার চাই তাজা খবর। নতুন কেউ মরার অপেক্ষায় ছাপাখানা।

খোঁড়া ,পচা,গলা সমাজ সমাজপতিদের পুঁজি। ফোঁড়া দেখিয়েই সমাজপতিরা পতি হন। সমাজের দুর্গতি দূর করার বুলি কপচান। সীমান্ত থেকে রাজধানী পর্য্যন্ত খোঁজ নিয়ে দেখুন নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থেই সমাজপতিরা  বংশানুক্রমে চালু রেখেছে তাদের মুরুব্বিয়ানা ব্যবসা। নতুন সমাজপতিরা আরো ধান্ধাবাজ। তারা সিদ্দিকী সাহেবের মৃত্যুকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে চাইবে। তবে সমাজপতিদের মধ্যে ব্যতিক্রমী ব্যক্তি অবশ্যই আছেন। আমরা চাই তারা ভাটেরা, বরমচাল, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার হয়ে সারা বাংলাদেশে এ খবর যেন পৌঁছে দেন। সিদ্দিকী সাহেবের খুন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। বিকলাঙ্গ সমাজ এ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী।

বাঙালি তার অত বড় অসুখের চিকিৎসা চায় না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় গুলো সমাজ বিদ্যার বিশাল বিশাল  বিদেশি তত্ত্ব নিয়ে খেটে মরছে রাত দিন। আর সিদ্দিকী সাহেবেরা খুন হলে আমরা জেগে উঠি। আবার ঘুমিয়ে পড়ি নিশ্চিন্তে আরেক সিদ্দিকী সাহেব খুন না হওয়া পর্য্যন্ত। প্রার্থনা করি পরবরর্তী খবরের শিরোনাম যেন আপনি না হোন।

আরও পড়ুন: হিন্দু নারীর পিতৃসম্পত্তির অধিকার বিষয়ে

লেখক: পার্থ প্রতিম নাথ 

 

parthiv

parthiv Means Earth Related. We Want To Learn Life Of Earth.

Post a Comment

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال