রাবণের অশোক বনে তোরাব খাঁ

রাবণের অশোক বনে তোরাব খাঁ

১৭ জুন ২০২০খ্রিস্টাব্দ। বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার, কুলাউড়া উপজেলার, ভাটেরা ইউনিয়নের জগতপুর গ্রামে তোরাব খাঁ নামক মানবরূপী দানবের হাতে নিহত সালমানের কাছে খোলা চিঠি।

প্রিয় সালমান,

তোর কাছে জানতে না চেয়েই বলে দিতে পারি,তুই ভালো আছিস। পৃথিবীর যে পাকা কাঁঠাল তোর প্রাণ নিল, বেহেস্তের উদ্যানে বসে তুই কাঁঠালের সঙ্গে কত ফল খাচ্ছিস দুই হাতে। আচ্ছা সরাবপুরের ধীরু মোহন্তের বাড়িতে যে আমরুজ ফল পাওয়া যেত, বেহেস্তের বাগানে সে ফল কি পাওয়া যায়? অবশ্যই পাওয়া  যায়। আল্লাহ মহান। তার বাগানে সব পাওয়া যায়। কাঁঠাল খাওয়ার অপরাধে তিনি কোন কিশোরকে মৃত্যুদÐ দেন না। এমনকি জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ার অপরাধে তিনি আদিমানব আদমকে মৃত্যুদÐ দেননি। শুধু বেহেস্ত থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আল্লাহ মাপ করলেও মাপ করেনি তোরাব খাঁ। লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ছাতু বানিয়েছে সালমানের মাথাকে। কী সুন্দর সালমান খান টাইপ চুল কাটিং দেওয়া মাথা। বন্ধুদের সঙ্গে হাকালুকি হাওরে নৌকা ভ্রমণে যাবে বলে কাটিয়েছিল। মায়ের কাছ থেকে পাওয়া পুরো পঞ্চাশটা টাকাই রেখে দিয়েছিল বিজয় শীল, চুল কাটার বিনিময়ে।

সালমান , তুইতো নিয়মিতই বনে যেতিস, লাকড়ি আনতে। অশোকবনের নাম শুনেছিস কখনো ? শুনিসনি। আচ্ছা শোন, পাঁচ হাজারেরও বেশি সময় পূর্বে শ্রীলংকার রাজা ছিলেন রাবণ। তাই তাকে বলা হত লংকেশ। বাল্মিকী নামক এক মুনি যখন রামায়ণ মহাকাব্য লিখেন তখন রাজা রাম হন বাল্মিকীর নায়ক। রামচন্দ্রের মত মহানায়কের বিপরীতে মহাতেজস্বী রাবণকে বেছে নেন ভিলেন হিসেবে। সেই থেকে রাবণ হোন রাক্ষস। অথচ রাবণের বাবা,দাদা সবাই ছিলেন নামকরা মুনিঋষি। সেই রাবণের ছিল অনেক দোষ, অনেক গুণ। তার অন্যতম গুণ ছিল তিনি ছিলেন বৃক্ষপ্রেমী। তার বৃক্ষপ্রেমের নিদর্শন ছিল অশোক বন।

বৃক্ষপ্রেমী রাবণের অশোক বন আজও স্বমহিমায় টিকে আছে। শুধু নেই রাবণ। রাবণের মালিকানাধীন বাগানের নতুন প্রভু, রাক্ষস নয়, দেবতা নয়, মানুষ। জগতপুর (বিশ্বসংসার) গ্রামে অশোক বনের মালিক তোরাব খাঁ (মানুষের প্রতিনিধি !)। তোরাব খাঁ অশোক ফুল পছন্দ করে না। তাই বাগানের সব অশোক গাছ কেটে ফেলেছে। লাগিয়েছে ফলদ বৃক্ষ কাঁঠাল। অশোক তার চরিত্র পাল্টিয়েছে পাঁচ হাজার বছরে। তাই মনে হয়, সীতা দেবীর মত কেউ আর তাকে পছন্দ করে না। নতুন প্রজন্ম অশোক ফুল চিনে না। স¤্রাট অশোককে চিনে অনেকে। হিং¯্র অশোক, শান্ত অশোক। ফুল অশোক বিরল। সজল ঠাকুরের বাড়ির পুকুর পাড়ে ছিল একটি অশোক গাছ। প্রচুর থোকা ফুল ধরতো। সজল ঠাকুর প্রতিদিন ¯œানের পূর্বে প্র¯্রাব সারতেন এর তলায়। মানুষের দিকে লজ্জা ঢাকতে অশোকের প্রতি এ অবিচার। কয়েক বছর ফুল ফোটাল না অভিমানে। তবুও টের পান না সজল ঠাকুর। প্র¯্রাব করতে গিয়ে একদিনও অশোকের প্রতি ফিরেও তাকান না এ ব্রাহ্মণ। অথচ বাড়ি ভর্তি ফুল লাগিয়ে রেখেছেন ঠাকুর পূজোর জন্যে। জবা, রঙ্গন, স্থলপদ্ম, শেফালি, বেলী, গন্ধরাজ কত ফুল। কিন্তু অশোকের প্রতি নেই কোন মায়া। শুধু ¯œানের পূর্বে জল বিয়োগের কালে তার ব্যবহার। রাবণ, রাক্ষস রাজা হয়েও ভালোবাসল তাকে। সবচেয়ে প্রিয় রমণীকে হরণ করে নিয়ে রাখল তার তলায়। কী বিরল সম্মান। এ যুগের ব্রাহ্মণ, তার এত অসম্মান করে। কে মহৎ রাবণ না সজল ঠাকুর ? ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই, ডালপালা গুটিয়ে ভেঙে পড়ল অশোক গাছ। কলিযুগে অশোকের আত্মাহুতি কার পাপে ? অশোকের সম্মান লোলুপ মনের কারণে। এ যুগের অশোকেরা মান সম্মানে ভয় পায় না। তলায় নয়, মুখে প্র¯্রাব করলেও, চেটে নেয় পরমানন্দে। তাইতো রাস্তার আশে পাশে দু একটি অশোকবৃক্ষ এখন ও টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।

জানিস, প্রিয় সালমান, তোর মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। তুই নেই এটা তিনি মেনেই নিতে পারছেন না। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে এভাবে-

‘সালমানের মা দুদিন ধরে কিছুই মুখে তুলছেন না। দু’দিন ধরে পনর বছর বয়সী ছেলেটা নিখোঁজ, কোন মা খেতে পারে ? ছোট মেয়ে সামিয়া একবাটি মুড়ি আর ঘিয়ালি করছা কতটি কাঁঠাল কোয়া রেখে যায় মায়ের সামনে। কাঁঠাল কোয়ার দিকে চোখ পড়তেই ছল ছল করে ওঠে মায়ের চোখ। কাঁঠাল কোয়ায় লেগে আছে সালমানের মাথার ঘিলু। তোরাব খাঁর অশোক বনের দিকে চোখ যায় মায়ের। সালমানের মা সালমা বেগমকে কেউ আর আটকাতে পারে না। মা জেনে গেছেন তার সন্তান কোথায়। উচুঁ টিলার উপরে , কাঁঠাল গাছের নিচে, একটা পাঁকা কাঁঠাল  ফেটে চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে আছে। তার পাশে উপুত হয়ে পড়ে আছে তার সালমান। ফালি হয়ে যাওয়া মাথা হতে ফেটে বেরোচ্ছে মগজ। ছড়ানো ঘিলু নিয়ে ভাগাভাগির খেলায় মেতেছে কালো পিঁপড়ারা। মায়ের চিৎকারে কেঁপে ওঠে বন। সালমান, সালমানরে...। 

এটা কোন নাটকের দৃশ্য নয়। ছেলেহারা মায়ের ক্রন্দন, বিলাপ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে জগতপুরে। তুমুল বৃষ্টি উপেক্ষা করে টিলার উপরে ওঠে আসে জগতপুরের মানুষ। জগতপুরের আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই আজ অশোকবনে। তোরাবখাঁর অশোকবনে। তারা দেখে, প্রত্যেকটি কাঁঠাল গাছের কোটর হতে বেরিয়ে এসেছে চোখ। তোরাবের চোখ। মানুষের মত নয়, রাক্ষসের মত। সবার মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কে রাক্ষস ? তোরাবখাঁ না রাবণ। অশোকবনে রাক্ষসরা সীতা দেবীকে পাহারা দিত। কোন সালমানকে মেরে খাওয়ার অপবাদ দিতে পারেননি বাল্মিকী তাদের ওপর। অবশেষে আসে পুলিশ। কাঁঠাল খাওয়ার অপরাধে মৃত সালমানের লাশ, কুলাউড়া থানার পুলিশের হাত ধরে এগিয়ে চলে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের দিকে। আবার পরীক্ষা দিতে হবে সালমানকে।  মরণপরীক্ষা।

আর কী লিখব ? তোর হত্যার বিচার হবে কি, হবে না । তোর বাবার মামলা চালানোর মত টাকা নেই। সে আল্লাহর দরবারে  বিচার দিয়েছে, দশটাকার মোমবাতি জ্বালিয়ে কালাশাহের মাজারে। সরকারবাদী একটা মামলা হয়েছে,কুলাউড়া থানায়। হত্যা মামলা। সরকারবাদী মামলা হয় যত ধীর গতিতে, তার নিষ্পত্তি ও  হয় আরো কচ্ছপ গতিতে। আশায় থাকিস। ইহলোক,  পরলোক সব জায়গায় আশাই ভরসা। 

চিঠির ইতি নেই, জগতপুরবাসী। রাবণের অশোক বনে তোরাব খাঁ।

লেখক: পার্থ প্রতিম নাথ 

আরও পড়ুন: এথেনা-সরস্বতী সংলাপ


parthiv

parthiv Means Earth Related. We Want To Learn Life Of Earth.

Post a Comment

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال