কুতুব

কুতুবুদ্দিন
কুতুব, ছবি: পৃথা দেবী

হাসপাতাল থেকে ছুটি পাচ্ছেন। অসুখ শেষ। সুখের শুরু। এমন অবস্থায় থাকা দুই রোগী। একে অপরের খোঁজ খবর নেন। এক পর্যায়ে আবিষ্কার করেন সপ্তম আশ্চর্যের মত একটা বিষয় দু'জনেরই নামই কুতুব। একজন কুতুবুদ্দিন অন্যজন কুতুব মিয়া । দুই কুতুবই সমবয়সী । ষাট এর  উর্ধ্বে বয়স। গল্পের ঝুলি দুজনেরই ভরা। দুজনই শব্দের মায়ায় আচ্ছন্ন প্রাণী। নতুন জীবন পেয়ে কথার ঝাঁপি যেন আপনার থেকেই খুলে যাচ্ছে । একজনের কথা শেষ হওয়ার আগেই আরেকজনের শুরু হয়ে যাচ্ছে। কথার বৃষ্টিতে ভিজে ক্লান্ত হচ্ছেন বড় হল রুমের মতো রুমে থাকা অন্যান্য রোগী। ভ্রু কুঞ্চিত করছেন নার্স ,কারোরই কোন দিকে খেয়াল নেই । দুজন নিজের মধ্যে মিল আর মিল খুঁজে বের করছেন। এক পর্যায়ে আবিষ্কার করলেন দুজনই ছিলেন সরকারি কর্মচারী।

এ যেন মেলায় হারিয়ে যাওয়া দুই ভাই । দীর্ঘদিন বিচ্ছেদের পর একে অপরকে ফিরে পেয়েছেন। দুজনেই দুঃখ বঞ্চনার হিসাব  মেলাচ্ছেন। সুখের হিসাব আপাতত কেউ করছেন না। কে জানে হয়তো মানুষের দুঃখ সমান তাই। সুখ আপেক্ষিক তাই হয়তো সুখের গল্প কম হয়। হয়তো দুঃখ ই জীবন, আর সুখ  জীবনাবসান। কুতুবুদ্দিনের বাড়ি কুমিল্লায় আর কুতুব মিয়ার বাড়ি কুলাউড়ায়। এখানেও অদ্ভুত মিল দুজনের। এলাকার নামের কারণে দুজনকে চাকুরী জীবনে অনেক গঞ্জনা সইতে হয়েছে । কুতুবউদ্দিন বলেন ভাই একবার আমার ট্রান্সফার হল সুনামগঞ্জে । সুরমা নদীর পাড়ে অফিস।  আমি সহ অফিসে ছিল আরো তিনজন লোক কুমিল্লার । সিলেটের লোক নয় বলে তারা সিলেটি ছাড়া সবাইকে আবাদি বলতো।  আবাদিদের মধ্যে আমরা চারজন। একই জেলার হওয়ায় বলতো সকল 'কু ʼতে মিল্লা কুমিল্লা। আমাদের ইঙ্গিত করে বলতো। নিজের জন্ম মাটি নিয়া কেউ কিছু বললে কলজেতে আগুন ধরে যেত ভাই। অফিসের বাহিরের মানুষগুলো ভালো হওয়ার কারণে সুনামগঞ্জের মাটি ছেড়ে আসার মন চাইতো না।


প্রায় পনর বছর থাকার পর বউ কন্যার যন্ত্রণায় আবার কুমিল্লায় ফিরে আসলাম। এসেই করলাম হার্ট অ্যাটাক। পনর বছরের কত স্মৃতি মনে হয়। সুরমা পারের মানুষ  সাদা কাদা মানুষ। কুতুবুদ্দিনের চোখে সুরমা নদীর জল । মুখে বারেকের টিলার বাতাস। দুই কুতুবের কাছে এই মুহূর্তে এটা যেন ঢাকার হার্ট ফাউন্ডেশনের হাসপাতাল না এটা নারায়নতলা মিশন । দুই বন্ধুর গল্পে মুখর ।


দুই কুতুব ইতিমধ্যে একে অপরকে মিতা বানিয়ে ফেলেছে। কুতুব মিয়া কুতুব উদ্দিনকে থামিয়ে বলেন, ওখোন থামো বা । আমিও তোমার মত কু তে কুলাউড়ার লোক। আমার দুঃখ র কথা হুনো।  কুতুবুদ্দিন বহুদিন পর সিলেটি মাত শুনে মুগ্ধ হন। এই মাতেই জীবন মাতামাতি। কথা ফুরিয়ে গেলে জীবনের অসহায়ত্ব  দেখা যায় চোখে। হায়রে কথা । মুখ ফুটার পর সারা জীবন , মরার আগ পর্যন্ত  কয়টা ভাল কথা বলে মানুষ ? কুতুব উদ্দিন বলেন মিতা আমিও হাফ সিলোটি। কিতা খও শুনি। কুতুব মিয়া বলেন তুমি মিতা এতক্ষণ সিলেটির দ্বারা নির্যাতনের গল্প শুনালে আমি নির্যাতিত হয়েছিলাম আমার কুলাউড়ার লোকের দ্বারা ।

 

আমি যে অফিসে কাজ করতাম তার হেড অফিস ছিল মিরপুরে। আমার প্রথম পোস্টিং ছিল সিলেটে । কিন্তু চার বছর পরেই হেড অফিসের বড়কর্তা সিলেট পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন আমার চেয়ে ভালো টাইপের লোক তার অফিসে নাই। তাই আমার টাইপিং দক্ষতা হল কাল। বউ বাচ্চাদের থেকে কেড়ে নিয়ে এলো ঢাকায় । আমার কর্তৃপক্ষ  বড় বেরহম কাজ করল আমার লগে। এখানে এসে পেলাম আমার এক কুলাউড়ি ভাই । তার বাড়ি বেড়কুড়ি গ্রামে।  আমার বাড়ি বরমচাল। ভাবলাম যাই হোক নিজের এলাকার মানুষ একটু শান্তিতে কথা বলার সুযোগ পাবো তার নাম কালাম। কালাম আমারই গ্রেড এর কর্মী । আমার ই সময়ের নিয়োগ। বয়সে চার পাঁচ বছরের বড় হবে। প্রথম দেখাতেই আমার তাকে কেমন যেন লাগলো। না ! সেও আমাকে ভালোভাবে নিতে পারল না।  এখনও মনে আছে প্রথম দেখাতেই আমাকে শোনানো তার ছিল্লোক। এটা জানোনি কুতুব ভাই ? আমি কইলাম কিতা ? বল্ল-

বরমচালি  মাটি

ফুটেনা লাঠি 

পিছলে না পাও 

চক্করছালি হিকতে হইতে হইলে

বরমচাল যাও ।


প্রথম দর্শনে ছিল্লোক শোনালেন ভাই, ইতিপূর্বে কোন বরমচালির হাতে বাঁশ খাইছেন নাকি ? তিনি বললেন না, রে ভাই আমি বেড়কুড়ির কালাম। আমারে বাঁশ দেওয়ার মতো কোনো মাইর পুত বরমচালে নাই । তোমারে এমনি কইলাম। ধরো ছোটবেলার পড়া রিভিশন দেয়ার মত। তোমারে দেখে বরমচালের কথা মনে হল তাই ছিল্লোক টা রিভিশন দিয়া রাখলাম। আমি আর কালামের সাথে মিল মিশ কোনদিন করিনি।  তিন বছর কোনমতে কাটিয়ে আবার সিলেটে বদলী হয়ে আসলাম ।

 

এভাবে মধুর গল্প চলছিল দুই নতুন বন্ধুর।  মিঠা তিতা বাক্য উচ্চ স্বরে চিল্লাচ্ছে দুইজন।  নার্স একবার গিয়ে নিষেধ করে এসেছেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা। কুমিল্লার কুতুব আবার বললেন ভাই সুনামগঞ্জে আরেক কুতুবের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল । তারে সবাই রিফুজি কুতুব ডাকত । এরা মূলত ভারতের আসামের এলাকা থেকে এসেছিল । তাই তার পরিচয় ছিল রিফিউজি। ভাই তার গল্প আপনাকে শুনতেই হবে । তার কারণে আমার বেজ্জতির শেষ ছিল না। সবাই কথায় কথায় বলতো ভাই আপনি তো দেখি রিফুজি কুতুবের মত হয়ে গেছেন।

 

কুতুব
কুতুব, ছবি: পৃথা দেবী

এই রিফিউজি কুতুব চাকরি করতো সড়ক ভবনে । তার বাসা ছিল ষোল ঘর পয়েন্টে। সে প্রথমে যখন সুনামগঞ্জে আসে তখন একা ছিল। থাকতো আমাদের মেসে বড় বাজারে। মেসে থাকতেই তার দুর্নাম ছড়িয়ে পড়েছিল শহরে। রবীন্দ্রনাথ যেভাবে বাংলা সাহিত্যের কোন অংশ সৃষ্টি হতে বাদ পড়েননি ,তেমনি সেও এমন কোন হীন কাজ নাই করেনি। জৈন্তাপুরে তার বাড়ি হলেও টাকা খরচ হবে বলে সে বছরে একবার কি দুইবার বাড়ি যেত । একবার তার মায়ের অসুখ হলে খবর নিয়ে এল তার চাচা। সে খবর দাতাকে প্রথমে জিজ্ঞেস করল , আম্মার অসুখ হলো কি করে ? খবর দাতাকে সে প্রশ্ন বানে জর্জরিত করতে লাগলো । তুমি নিশ্চই কোন কু মতলবে আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাও । তুমি জানো আমি যতদিন এক ভরি ওজনের সোনার চেইন যৌতুক হিসেবে না পাবো,ততদিন বিয়ে করব না। তুমি কৌশলে তোমার মেয়ের  সাথে আমার বিয়ে দিতে চাও। তাই মায়া দেখিয়ে খবর দিতে এসেছ। আমার মা কি বিছানায় পড়ে গেছে ?  উঠতে পারে না  ? খাইতে পারে তো নিজে তুলে ? নাকি তুলে খায় না । তোমার মেয়ে হয়তো আগেই গিয়ে বউ হয়ে বসে আছে। তাকে ভাতের  লুকমা তুলে খাওয়াচ্ছে । তার বাপের সমান লোকটি লজ্জায় কোন উত্তর দিচ্ছে না । সে মনে দুঃখ নিয়ে ফিরে গিয়েছিল। 

 

শুনেছি এই লোকটি নাকি মনের দুঃখে কোন গাড়িতে চড়তে ভুলে গিয়েছিল। মাইল পাঁচেক পায়ে হেঁটে শহর থেকে আছান মারা ফেরি পর্যন্ত গিয়েছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ,তুমি ভদ্রলোকের সাথে এমন ব্যবহার করলে কেন ? সে বলল কোন ভদ্রলোক ? এটা একটা ভদ্রলোক ! ভদ্রলোক সম্পর্কে আমার চাচা হয়। বিনা পয়সায় মেয়েটাকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিতে চায় । তাছাড়া আমি সরকারি চাকরি করি। আমাকে দখল করার লোভ আছে না? তাই শ্বশুর হওয়ার হাউস মিটিয়ে দিয়েছি। জানি আমার মা অত সহজে অসুস্থ হওয়ার মত মহিলা না। আর যদিও অসুস্থ হন মরার মত অবস্থা নিশ্চই হয়নি। আমার দিলে তো কোন টান পড়েনি। আমাকে বাড়ি নেওয়ার বাহানা কত !

 

পরের সপ্তাহে তার মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শেষে বাড়ি যায় কুতুব। তাও তার বাবার মুখের কথা টেলিফোনে শুনে নিশ্চিত হয়ে বাড়ি যায়। অফিসে টেলিফোন সংযোগ সবেমাত্র হয়েছিল । তারপর মায়ের কবর দিয়ে ধর্মীয় কাজকর্ম সে কুতুব বাধ্য হয়ে ঐ খবর দাতা লোকের মেয়েকে বিয়ে করে। গ্রামের মানুষ আর তার বাবা তাকে বিয়েতে বাধ্য করে ওয়াদা পালন করায়।

 

কুতুবের বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। কুতুবের জীবনের সকল লেখাপড়ার খরচ দিয়েছে ওই ব্যক্তি, তার চাচা। বিয়ে দেওয়ার জন্য তার মেয়েকে ওই বিদ্বান ছেলের সাথে।  কিন্তু চাকরি পাবার পর কুতুবের লোভ বেড়ে যায়। তাই হবু শ্বশুরকে দেখলেই বেইজ্জত করার চেষ্টা করত। শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। বিয়ে করে রিফুজি কুতুব এলো কর্মস্থলে। কিন্তু আর বাড়ি যাবার নাম নেই। মাসের পর মাস যায় সে নতুন বউ বাড়িতে রেখে এসেছে। কিন্তু বাড়িতে যাবার নাম করে না। খোঁজ খবরও নেয় না। চিঠিপত্র দূরে থাক পোস্ট অফিস থেকে টেলিগ্রাম  আসলেও সাড়া দিত না। এমন নির্মম আচরণে কেউ তাকে সাপোর্ট করেনি। কারণ যে কুতুব মায়ের অসুখের খবর শুনে বাড়ি যায় না সে পরের মেয়ের জন্য মায়া দেখানোর লোক না। আমরা মেস থেকে রিফুজি কুতুবকে তাড়িয়ে দেবার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কারণ তিন মাস ধরে মেসের ভাড়া বাকি পড়েছে। তাছাড়া প্রায় দিনই মিল বন্ধ করে রাখে। ফাও খাওয়ার ধান্দায় মসজিদ মন্দির বিয়ে বাড়ি, শ্রাদ্ধ বাড়ি খুঁজে বেড়ায়। অন্যের মিল  খেয়ে না বলে বেরিয়ে যায়। তার নিজের সাবান নেই । বিছানা নেই । শার্ট প্যান্ট নেই। যখন যারটা পাচ্ছে সেটাই ব্যবহার করছে। কেউ কিছু বললে আবার ঝাড়ি মারছে। ব্যাটা আমি কি তোদের মত ছোটলোক? আমি চৌধুরী বংশের পোলা। সত্যিই চৌধুরী পদবীর লোক ছিল কুতুব। রিফিউজি নামের আড়ালে ঢাকা পড়েছিল তার চৌধুরী। 

 

যাক, এত বড় উৎপাত কি আর এমনিতেই যায়? আমাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদায় করতে হলো না। একদিন মেসে এসে হাজির হলো তার স্ত্রী ও শ্বশুর। কুতুব পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, পারেনি। তার অফিসের লোকের সহায়তায় আর নির্বাহী প্রকৌশলীর উদ্যোগে সবাই মিলে জোর করে একটি টিনের বাসা কম ভাড়ায় ঠিক করে দিলাম। সবাই ভাবলো যাক, বউটার মায়ায় কুতুব এখন কিছুটা মানুষ হবে। কিন্তু কুত্তার লেজ ঘি দিয়ে মাখলেও সোজা হয় না। কয়দিন পরে আমাদের অবাক করে মেসে হাজির কুতুবের বউ। লজ্জায় নত হয়ে আছে। মরে যাচ্ছে এরকম চেহারা। কদিন ধরে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে না। আমরা আর মহিলাকে প্রশ্ন করে কথা বলতে দিলাম না। বাজার সদাই করে বাসায় নিয়ে গেলাম। কুতুব বাসায় নেই বাসার মালিক বাসার সামনে অপেক্ষা করছে।

 

কুতুবের বউই তাকে খবর দিয়ে এনে বাসার সামনে দাঁড় করিয়ে তারপরে আমাদের ওখানে গিয়েছিল। মার্জিত মহিলা আমাদের এবং বাড়িওয়ালাকে অনুরোধ করলেন ছোট বোন মনে করে একটু অপেক্ষা করুন। আপনারা বসুন আমি তাড়াতাড়ি আপনাদের জন্য একটু চা করে আনছি। জানি আপনাদের অনেক সময় আমি নষ্ট করছি। কারণ আমি নিরুপায় ।এখানে আসার পর উনি রাত এগারোটার পর বাসায় এসেই ঘুমিয়ে পড়েন । আমি খেলাম কি না খেলাম তার খোঁজ নেন না। উনি কি খাবেন তাও জানেন না। বাজার থেকে কোন খাবার কিনে আনেন নি কখনো। বাড়িওয়ালা কথা বললেন আমাদের উদ্দেশ্য, আপনারা কুতুব সাহেবের বন্ধু ,তাই বলছি এ লোকটি একটি বদমাইশ। এখানে ও টিকবে না আর মেয়েটিকে মেরে ফেলবে। মেয়েটিকে তার বাবার বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আর আমি তার মতো লোককে ঘর ভাড়া দেব না। আমরা জিজ্ঞেস করলাম কেন সে আপনার ভাড়ার এডভান্স টাকা দেয়নি ? এগ্জিএন সাহেব নিজ হাতে প্রথম মাসের বাড়ি ভাড়া উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। চোখ কপালে তুলে বাড়িওয়ালা বললেন ,সে বলছে বাড়ি ভাড়ার তিন ভাগের একভাগ আমাকে দেবে।


কারণ সে বাড়ির পানির লাইন ব্যবহার করবে না। ওই যে দেখুন, কোত্থেকে ভাঙ্গা ড্রাম এনেছে। আর মোড়ের ওই ডোবা থেকে ময়লা পানি এনে ভর্তি করে রেখেছে। পানি খরচ না হয় সেজন্য সে প্রতিদিন সকালে নদীর পাড়ে গিয়ে টয়লেট সারে। তারপর কামারের দোকান থেকে ছাই নিয়ে দাঁত মেজে সোজা চলে যায় রামকৃষ্ণ মিশনে। ছাত্রদের প্রার্থনা শেষের অপেক্ষায় থাকে। সে প্রসাদ খায়। মিশনে নাকি বক্তৃতা দেয়। সে তার অফিস স্টাফদের মধ্যে সে সবচেয়ে উত্তম। সে খরগোশ আর কচ্ছপের মধ্যে কচ্ছপ নীতি পছন্দ করে। তাই তার পরাজয় অসম্ভব। ব্যাখ্যা দেয় আমি প্রাতঃকালে ঘুম থেকে উঠি। আর নদীর পাড়ে হাওয়া খাই। নদীর পারে সে কুকর্ম করতে যায়। এটা ছাত্ররা জানে তবুও তাকে বলতে দেয়।  মন্দির বলে কথা। বাক স্বাধীনতায় বাধা দেয় না, দেয়া যায় না। সে আরো বলে আমার অফিসের বাকি কলিগরা হলো খরগোশের দলে। তারা সাড়ে নটা হবার দশ মিনিট আগে ঘুম থেকে উঠে আর পঙ্খিরাজ চড়ে দশ মিনিটে অফিসে আসে। আমি সড়ক বিভাগের লোক। শহরের সমস্ত সড়ক হেঁটে পরিদর্শন করে, তারপর সবার আগে অফিসে হাজির হই। সবার আগে অফিসে হাজির  হলাম না তো কিসের সরকারি কর্মচারী ? তাছাড়া আমি তো আর এদের মত উপরি কামাই না, যে দামি দামি পঙ্খিরাজ কিনব। কুতুবের অবস্থা তার অফিসে ছিল একেবারে খারাপ। কেউ থাকে পছন্দ করত না। কারণ সে কোন কাজ করত না। কারণ করণিক কাজে সে আনন্দ পেত না। সকাল থেকেই হাটাহাটি করে নাস্তা জোগাড় করে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়তো। যেদিন মিশনে নাস্তা পাওয়া যেত না সেদিন নাস্তা না খেয়েই আসতে হতো। এসে চেয়ারে বসেই দেয়ালে মাথা ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। যেখানে ঠেস দিয়ে ঘুমাতো সেখানে খুব গভীর গর্ত হয়ে গিয়েছিল।

কুতুব, ছবি: পৃথা দেবী
কুতুব, ছবি: পৃথা দেবী

মানুষের শরীর বড় ডেঞ্জারাস জিনিস। যে মাথায় একটুকুও আঘাত লাগলে কাতরায়  সেই মাথা সিমেন্টের ইটের দেয়াল কেউ গর্ত করে দেয় ! মাটির কলসি যেভাবে পুকুর ঘাটে রাখলে রাখতে রাখতে ক্রমশ গর্ত হয়ে যায় ঠিক একই রকম।সিটে বসা না থাকলে অফিসের বিভিন্ন শাখার লোক এবং আগত অফিসের অন্যান্য লোক পর্যটন স্থানের মত করে কুতুবের বসার স্থান দেখত আর মাথার ঘসায় হয়ে যাওয়া গর্ত দেখে অবাক হতো। বারোটা বাজার সাথেই আবার দৌড় পড়ে যেত কুতুবের। কোথায় ফাও খাবার পাওয়া যায় ? কুতুব এতিমখানা পর্যন্ত অভিযান চালাত ফাও খাবারের উদ্দেশ্যে। অফিসের কেউ তার বেতনের টাকার সম্পর্কের জিজ্ঞেস করলে সে ক্ষেপে উঠতো। আমার বেতন আমার টাকা তোমার বাপের কি ? কেউ কথা বলত না। বউটার নির্যাতনের খবর পেয়ে তার বাবা এসে তাকে নিয়ে চলে যায়। তারপর আমরা আর তাকে মেসে জায়গা দিইনি ।

 

সে গিয়ে ওঠে আরফিন নগরের মসজিদ মেসে। সেখানে সে আমার নাম ভাঙিয়ে আমার অজান্তে থাকতে শুরু করে। আরফিন নগরের মসজিদে আমি নামাজ পড়তাম। মোতওয়ালি সাহেবের সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তাছাড়া মাঝেমধ্যে দান খয়রাত করতাম। কুতুব সব জানত। সুযোগ কাজে লাগায় কুতুব।  মোতওয়ালিকে বোঝায়, আমার ভাড়া আমার বন্ধু আপনাকে মিটিয়ে দেবে এ ব্যাপারে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। কুতুব উদ্দিনকে তো আপনি চিনেন সে রিফিউজি কুতুব না।

 

মসজিদের পাশে একটা মুদি দোকান ছিল সেখান থেকে সে নিয়মিত সওদাপাতি কিনত। আমার নাম করে একদিন সে পঞ্চাশ কেজির এক বস্তা চাল কিনতে গেল। তার কাছে মাসের বাকি টাকা পড়ে আছে। যে লোক সবসময় দুই বা এক কেজি চাল নেয় সে আজ চাচ্চে পঞ্চাশ কেজি চালের বস্তা। সে রিফিউজি কুতুবকে ফেরায় না। চাল দিয়ে চলে আসে আমার অফিসে । আমি দোকানদারকে তার ট্রেড লাইসেন্স পাইয়ে দিতে সাহায্য করেছিলাম সেই থেকে সে আমায় শ্রদ্ধা ভক্তি করে। গরীবের এই এক ধর্ম বড়লোক হওয়ার আগে অন্যের ছোটখাট উপকার স্বীকার করে। তাছাড়া আমাদের মেসের যাবতীয় মুদি খরচ তার দোকান থেকে আসে। তাই রিফিউজি কুতুব যখন টাকা না দিয়ে আমার রেফারেন্স দিয়েছে সে লজ্জায় আমাকে কিছু বলেনি। আজ সন্দেহ হওয়ায় এসেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম সে এখন কোথায় ? দোকানদার বলল , সাব বাড়ির ঘাটের দিকে যেতে দেখলাম । ঘাটে গিয়ে দেখি রিফিউজি কুতুবের নৌকা মাঝ নদীতে। দূর থেকে পঞ্চাশ কেজি ওজনের চালের বস্তা দেখা যাচ্ছে। আর তার মোটা পেট এখনো চোখের আড়াল হয়নি । যদিও ছোট মাথাটা দেখা যাচ্ছে না। শুধু মাথার সাদা টুপিটা ফুলের মত দেখাচ্ছে। খবর নিয়ে জানা গেল কুতুবের বদলি হয়েছে সিলেটে তাই তার বিদায়ের আগে সে এই লুটপাটে নেমেছিল। আমি চুকিয়ে দিলাম রিফিউজি কুতুবের ঋণ। অনেকেই নিতে চায়নি। কিন্তু কুতুব নামকে কলঙ্কমুক্ত করতে এ কাজটি করেছিলাম। কারণ মনীষীরা বলেছেন, মানুষ যেমন তেমন হোক তার নামের যেন বদনাম না হয় । কুলাউড়ার কুতুব হেরে গেলেন কুতুব উদ্দিন এর কাছে। রিফিউজি কুতুবের গল্প শোনার পর আর কি গল্প তার বলার থাকতে পারে ?


গল্প :লেখক -পার্থ প্রতিম নাথ (গল্প কাকতালীয়, বাস্তবের নামের ,ঘটনার মিল খোঁজবেন না দয়া করে)


parthiv

parthiv Means Earth Related. We Want To Learn Life Of Earth.

Post a Comment

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال