গুগল ও বাংলা অভিধান সমূহ একই সুরে বলে দুর্ঘটনা একটি অদৃষ্টপূর্ব, অকল্পনীয়এবং আকস্মিক ঘটনা বা বিষয় যা প্রায়শঃই অমনোযোগীতা কিংবা প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের ফলে সৃষ্ট হয়ে থাকে। সচরাচর ক্ষেত্রে এটি প্রায়শঃই ব্যক্তিকেন্দ্রীক, মানসিক কিংবা সামাজিক বিপর্যয় বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আকস্মিকভাবে ঘটনা ঘটার পূর্বেই যদি দুর্ঘটনা চিহ্নিত করা যায় তাহলে এ সমস্যা দূর করা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।
০৭.০৬.২০২৩ তারিখে প্রায় সকল পত্রিকায় অনলাইনে প্রকাশিত খবরটি পড়ুন। তারপর আপনারা যারা এখনো দুর্ঘটনার স্বীকার হননি। তারা আমার কয়েকটি সওয়ালের জবাব দিন প্লিজ।
সিলেট নগরের আম্বরখানা থেকে অন্তত ৩০ জন শ্রমিক ঢালাইকাজের জন্য পিকআপ ভ্যানে করে ওসমানীনগর উপজেলার গোয়ালাবাজারে যাচ্ছিলেন। পথে আজ ভোরে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজারে দুর্ঘটনায় পড়েন তাঁরা। এতে ১৪ জন নিহত এবং ১০ জন আহত হয়েছেন।
আজ বুধবার ভোরে সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষে মৃত মানুষের সংখ্যা বেড়ে ১৪ হয়েছে। তাঁদের সবার নাম-পরিচয় পেয়েছে পুলিশ।
নিহত ১৪ জন হলেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার মো. সিজিল মিয়া (৫৫), একলিম মিয়া (৫৫), হারিছ মিয়া (৬৫), সৌরভ মিয়া (২৭), সাজেদুর (৬০), বাদশা মিয়া (৩০), সাধু মিয়া (৫০), রশিদ মিয়া (৫০) ও মেহের (২৫); সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার শাহীন মিয়া (৪০), দুলাল মিয়া (২৬) ও আওলাদ হোসেন (৫০); হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের আমিনা বেগম (৪৫) এবং নেত্রকোনা বারহাট্টার আওলাদ মিয়া (৪০)।
আসলে সড়কে মৃত্যু কি দুর্ঘটনা ? এটা কিএকটি অদৃষ্টপূর্ব, অকল্পনীয় এবং আকস্মিক ঘটনা? মোটেই না। বাংলাদেশের সড়কের মৃত্যু ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড। কারণ একই স্পটে দীর্ঘদিন ধরে দুর্ঘটনা ঘটছে কর্তৃপক্ষ রাস্তা মেরামত না করে লিখে রেখেছে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা। অর্থ্যাৎ মরলে নিজ দায়িত্বে মরুন। অথচ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করলেও জরিমানা গুনতে হয় কোন কোন ক্ষেত্রে। সেই রাস্তা ত্রুটির কারণে আপনি গাড়ি দুর্ঘটনায় মরলেন।
দোষ কার রাস্তার না আপনার ? দুর্ঘটনা হতেই পারে তবে বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা অদৃষ্টপূর্ব, অকল্পনীয়এবং আকস্মিক ঘটনা নয়। এটা একটা নৈমিত্তিক ব্যাপার। ত্রুটিপূর্ণ রাস্তা, ঘুমন্ত-অশিক্ষিত-অদক্ষ-প্রশিক্ষণ বিহীন চালক, ফিটনেস বিহীন গাড়ি,অসচেতন অসহায় যাত্রী রাস্তায় এসবের বিপুল সমাবেশ ঘটিয়ে আমরা কিভাবে দায়মুক্ত হব। রাজপথ দখলে, বগলে রাখব।
শুধু সড়কে মরলেই বলব দুর্ঘটনা তাই কী হয় ? মনুষ্য সৃষ্ট ইচ্ছাকৃত ঘটনাকে আমরা দুর্ঘটনা বলতে পারি না। বিশাল ঝড়ে পাঁচজন মরলেও সেটা খবর হয় দুর্য্যোগ হিসেবে? সড়কে আর কত লাশ পড়লে এটাকে আমরা মড়ক হিসেবে নেব ? সড়কে মৃত্যুর খবর আমাদের কাছে স্বাভাবিক ঘটনা। আহতরা মৃত্যুর চেয়ে ভয়াবহ দিন পার করছে সে খবর কে রাখে ? একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না- সড়কে মৃত্যুরোধে দায়িত্ব সারা হয়ে গেল ? আমাদের এ আচরণ ভবিষ্যতের জন্যে অশুভ সংকেত। এই অশুভ শব্দটির সাথে বাংলা অভিধান সড়কের মৃত্যুর ঘটনাকে দুর্ঘটনার কাতারে ফেলতে পারে।
রাস্তায় এত মৃত্যুর পরও রাস্তার মালিকেরা, গাড়ি-ঘোড়া দেখার লোকেরা নির্বিকার। তাহলে আমরা কী ধরে নেব তারা হাল ছেড়ে দিয়েছেন ? ষোল কোটি মানুষ আর ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে অন্ততপক্ষে রাস্তায় নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়!
সড়ক দুর্ঘটনা বলে যা চালানো হয় তা মূলত মৃত্যুর ভুল পরিসংখ্যান। পুলিশ আর ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে যে হিসাব রাখা হয়, তাতেই সারা হচ্ছে হতাহতের হিসাব-নিকাশ। মৃত্যু নয় অপমৃত্যুর হিসাব হচ্ছে । সিস্টেমের ভুলের স্বীকার হয়ে মরেও শান্তি নেই। মিলছে অপঘাতে মৃত্যুর তকমা। ধর্মীয় রীতিতে অনেকেরই ক্রিয়াকর্ম হচ্ছে না। সড়কে মৃত্যু কি তাহলে পাপের ফল ?
মৃত্যুর কারণ হিসেবে লিপিবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে গতানুগতিক ডাটা। সরকারী চাকুরীর প্রশ্ন পত্রের মত যা বছরের পর বছর একই থাকছে। চালকের চোখে ঘুম ছিল, মনে অবহেলা ছিল, গাড়িতে যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল,ফিটনেস ছিল না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের দেশে অগাছার মত বাড়ছে বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়। যে ঘটনায় প্রতিদিন রাস্তায় ঝরছে প্রাণ তার বিশেষ অধ্যয়নের, গবেষণার জন্য নেই উদ্যোগ।
সড়কের মৃত্যুকে মনুষ্য সৃষ্ট দুর্য্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা সময়ের দাবি। দুর্ঘটনার নামে বন্ধ হোক হত্যা, মৃত্যু, অপমৃত্যু বা স্বেচ্ছা মৃত্যু। সড়কের মৃত্যু প্রতিরোধে সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সমূহকে আরো আন্তরিক হতে হবে। সবকিছু ঢেলে সাজাতে হবে। ইস্ত্রি ছাড়া কাপড় পরেন না। অথচ দিনের পর দিন ঘুণে ধরা সিস্টেমকে আঁকড়ে রেখেছেন। মরলে লাশ গুনছেন ,এভাবে আর কত ? এক চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন আর তার নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন অত মানুষকে বাঁচাবে কী করে ? আন্দোলনটাকে বড় করতে হবে যে!
এই লেখাটি পড়ে পাঠক বলতে পারেন, লেখক সাহেব এই লেখাতেই আপনার দায়িত্ব শেষ ? আমি বলব না। যতক্ষণ সড়কে একটি মৃত্যুও হবে আমি ততক্ষণ লিখতে থাকব। আপনি ড্রাইভার, আপনি প্রশাসক, আপনি পুলিশ, আপনি যে কোন পেশাজীবি, কর্মজীবি, আম জনতা। আপনিও নিজ অবস্থান থেকে কাজ করুন,সচেতন হোন। নইলে এধারা চলতে থাকলে সবাইকে একদিন কাঁদতে হবে রাস্তায়।
লেখক: পার্থ প্রতিম নাথ
আরও পড়ুন: একটি অবাণিজ্যিক পরামর্শ