ইউরোপ , আমেরিকা , আফ্রিকা এবং স্বাগতিক এশিয়ার দেব দেবীরা প্রায় সকলেই উপস্থিত হয়েছেন বিশ্ব সম্মেলনে । সম্মেলন খুবই গুরুত্ব বহন করছে এবার । দেব দেবীদের কার্য্ক্রম অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান হাতে নেয়া হয়েছে । প্রথম দিনেই হবে ইউরোপের জ্ঞানের দেবী এথিনা ও এশিয়ার জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর সংলাপ । এশিয়ান দেবতাদের মুখপাত্র নারদ যথারীতি প্রথম দিনের প্রথম পর্বের সঞ্চালক হিসেবে ভূমিকা পালন করছেন । মঞ্চে আসন নিয়েছেন নামী দামী দেবতারা ।
মহাদেব , ব্রহ্মা , বিষ্ণু , এপলো , জিউস , অ্যাফ্রোদিতি , দুর্গা , কালি , লক্ষ্মী, কুবের সবাই আছেন । বড় সংকটে পড়েছেন দেব দেবীরা । বিজ্ঞাপন ছাড়া যে রাজত্ব ছিল তাদের তাও এখন দু্র্মতি মানব বুদ্ধির জন্যে হুমকির সম্মুখীন । এথেনা, সরস্বতীকে সম্ভাষণ করে নারদ শুরু করলেন। হে জ্ঞানের দেবীগণ ,আমরা দেবতারা এখনো বিশ্বাস করি, ‘নোলেজ ইজ পাওয়ার।’ তাই দেবাদিদেব মহাদেব এবং মহান প্রভু জিউস ঠিক করেছেন তাদের জ্ঞানের পুত্রীগণ হবেন এ সম্মেলনের আলোক বর্ত্তিকা। জ্ঞানের মশাল জ্বেলেই দূর হবে অন্ধকার। তাই দেবীগণ শুরু করুন আপনাদের সংলাপ ।
নারদ তার স্থান দখল করলেন। মঞ্চে শুভ্রবসনা সরস্বতী, হাতে বীণা পায়ের কাছে রাজহাঁস। সাউন্ডসিস্টেম এসেছে দিল্লী থেকে। সুলোলিত কন্ঠে সরস্বতী স্বাগত জানালেন দেবী এথিনাকে। শিল্পি ফিডিয়াস এর কুমারী ডিজাইনে এসেছেন এথিনা। পার্থেননে দেবী যেভাবে সেজেছেন এভাবেই সম্মেলনে এসেছেন। দেবতারা চোখ ফেরাতে পারছেননা। জিউসের মাথা থেকে এথিনার জন্ম। ধন্য জিউস। হে দেবী এথিনা আপনি জ্ঞানের দেবী। আমিও জ্ঞানের দেবী। তবে আপনার আর আমার অনেক ফারাক। আপনি এথেন্সের উপাস্য দেবী। আমার কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই। মন্দির নেই বললেই চলে। ভালো রেজাল্ট এর আশায় ছাত্ররা আর তাদের লোভী অভিভাবকরা বছরে একবার পূজা করে।
কোন খরচ হবে না বলে স্কুল কলেজ ব্যবহার করে। আর স্কুল কলেজের শিক্ষকরা ভর্তরি সময় আদায় করা টাকা হালাল করার জন্য দায়সারা পূজা সারে।সার্টিফিকেট আর চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গেলে প্রায় সবাই আমাকে ভুলে লক্ষ্মী দিদির পূজা করে। ধন পাওয়ার পর শক্তির পূজা করে। আমার মা দুর্গা পূজা করে। তখন বাঙালি বলে ‘পাওয়ার ইজ নোলেজ। ‘ মায়ের সাথে আমার পুরো পরিবারের পূজা হয়। দু তিন জন পুরোহিত চার পাঁচ দিন ধরে পূজা করে।
আমার জ্ঞানের মূল্য নেই দেবী এথিনা। এক কৌষ্ঠকাটিন্যভোগা পুরোহিত একদিনে একশটা ঘরে আমার পূজা করে। সুযোগ পেলে অহিন্দুরাও পূজা করে। একবার কলকাতায় মূজতবা আলী নামে এক যবন আমার পূজায় পৌরহিত্য করেছিল কেউ টের পায় নি। এ দুঃখ বলার জায়গা নেই। সকল দেবতা নিজেকেই নিয়ে ব্যস্ত। জ্ঞান তৃষ্ণা যেখানে দেবতাদের নেই সেখানে মানুষের থাকবে কী করে? দেবতাদের দেখাদেখি মানুষ ভোগারতিতে মত্ত। এদের রুখবে কে ?আমি তো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ছাড়া কাউকে দেখিনা। পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সে এ বিশ্বকে ছাই করে দিক। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের খেতা মারি। মুখ খোললেন দেবী এথিনা, না মহাশ্বেতা, না। আপনার ক্রোধ শোভাপায় না। আর শব্দের কোমলতা সেতো আপনার দান। নারদ ঘোষণা দিলেন চা বিরতি।
মহাদেব নন্দীকে ইশারা করলেন। নন্দী বুঝে নিল বাবার চায়ে রুচি নেই সিদ্ধি লাগবে। জিউসের জন্যও আলাদা কলকে চিলিম এল। তারা ব্যাক স্টেজে কাম সেরে এলেন। অ্যাফ্রদিতিকে পেয়ে দেবতা কামদেবের আনন্দের সীমা নেই। তিনি বিপদের মধ্যে
আনন্দ নিতে চান। তাই ইউরোপিয়ান সৌন্দর্যের দেবীর কাছে তিনি নন্দনবিদ্যা শিখতে চান। দেবরাজ ঈন্দ্র কামদেবের বালখিল্যতায় ক্ষিপ্ত হয়েছেন।
নারদ আবার সংলাপ শুরুর ঘোষণা দিলেন। এবার এথিনা বলবেন। দেবী সরস্বতী আপনি নিশ্চই শান্ত হয়েছেন। আপনার কথা যদি আমি বুঝতে পারি তাহলে আমি বলব আপনি আপনার নিজের দুর্গতির কারণ নিয়ে ভাবছেন। সকলের নয়। এটা ঠিক নয়। এটা অবশ্য অপনাদের নীতি নির্ধারকদের ভুল। এই যে আপনাকে কয়েক হাজার টাকা দামের রাজহাঁসটা দিয়েছে সে আপনাকে কোন পরামর্শ দিতে পারে না্। শুধু দুধ আর জল থেকে দুধটুকু বেছে খেতে পারে। আর আমার পেঁচার দিকে তাকান সে অন্ধকারে দেখতে পারে। সে আমাকে অন্ধকারে আলো দেখায়। আপনারা পেঁচা দিয়েছেন সম্পদের দেবীকে। আপনাদের পেঁচা লুন্ঠনকারীকে সম্পদ দেখিয়ে দেয়। তাই আপনাদের সমাজে জ্ঞানীর অভাব আর লুন্ঠনকারীর প্রভাব। কিছু মনে করবেন না ।
বিপদে বাঁচার সংলাপ না করে জ্ঞান দিয়ে দিলাম। এটা আমাদের ইউরোপিয়ানদের স্বভাব। তবে সত্যি কথা কি দেবী ,এথেন্সে আমার সুউচ্চ মন্দির ,মূর্তি আছে ঠিকই। কিন্তু সম্মান আগের মত নেই। মানুষ আগের মত ডেলফির মন্দিরে ওরাকলের কাছে যায়না। মানুষ ভবিষ্যৎ বাণী শুনতে চায় না । ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে দেখাতে চায়্। আমার দেয়া জ্ঞানেই বয়ন শিল্প আর জাহাজ শিল্পে ইউরোপিয়ানরা এত উন্নত। গ্রীকদের জ্ঞান দিয়ে আমি কত যুদ্ধ জিতিয়েছি, কত পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছি। সক্রেটিস সোফিস্ট, গণতান্ত্রিক, রাজতান্ত্রিক সকল মতধারা গ্রীক আমাকে সম্মান করেছে। আজ অবস্থা দেখুন। জ্ঞানের নগরীতে আজ আনতর্জালিক বিস্তার। দেবতায় বিশ্বাস কমেছে মানুষের। তাই আর অপেক্ষা করা যায় না। আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দেশে দেশে ধর্মালয় বাড়াতে হবে।
চতুর্থ বিপ্লবেই থামাতে হবে মানুষকে। যদি এমন না হয় পঞ্চম বিপ্লবে আমরা চলে যাব মানুষের কাতারে আর মানুষ উঠে আসবে দেবতাদের সারিতে। দেবী সরস্বতী যেমন অদৈর্য্য হয়ে পুতিন কে ডেকেছেন। পুতিনকে ডাকা যাবে না যা করার আমরা দেবতারা করব। মানুষকে মারব বাঁচাব, তবেই না আমরা ঈশ্বর।
এথিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই নারদ ঘোষণা দিলেন, সম্মানিত উপস্থিতি একটু পরেই মধ্যাহ্ণ ভোজন শুরু হবে। নিজ নিজ ক্যাটাগরী অনুযায়ী আসন গ্রহণের জন্যে সকলকে অনুরোধ করা হল। দেবতারা একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন। নারদ ইচ্ছা করেই কি এরকম ঘোষণা দিলেন। খাবার টেবিলে বসা নিয়ে এবার শুরু হবে দক্ষযজ্ঞ। কার চেয়ে কে বড় ? এ লড়ায়েই পণ্ড হবে জ্ঞানের সংলাপ। হবে যুদ্ধ । এ যুদ্ধ থামাবে কে ?
লেখক: পার্থ প্রতিম নাথ
আরও পড়ুন: গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর